১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল। মানুষের ভুলের কারণে প্রযুক্তি কতটা ভয়ংকর হতে উঠতে পারে, তার সাক্ষী হয়ে আছে দিনটি। এ দিনে চেরনোবিল নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টে ঘটে যায় এক নিউক্লিয়ার বিপর্যয়, যার প্রভাব এতদিনেও কমে যায় নি। কী ঘটেছিলো সেদিন? দুর্ঘটনার পর পরিস্থিতি কেমন ছিলো? খুব সংক্ষেপে জেনে নেয়া যাক।
চেরনোবিল নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট কোথায় ছিলো?
ইউক্রেনের (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীন) রাজধানী কিয়েভ থেকে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার উত্তরে বেলারুশ সীমান্তের কাছে এর অবস্থান। প্ল্যান্টের কর্মীদের থাকার জন্য নব্য নির্মিত প্রিপেয়াট শহরের কাছাকাছি তৈরি করা হয়েছিলো এটি। প্ল্যান্টের পাশে প্রায় ২২ কিলোমিটার আকারের একটি কৃত্রিম জলাধার রাখা হয়, যেখানে পাশের নদী থেকে পানি জমা হতো।
নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টটি কেমন ছিলো?
“RBMK-1000” ধরনের চারটি রিঅ্যাক্টর ছিলো প্ল্যান্টে। এ ব্যবস্থায় পানিকে উত্তপ্ত করতে ইউরেনিয়াম-২৩৫ ফুয়েল ব্যবহার করা হতো। উৎপন্ন বাষ্প রিঅ্যাক্টরের টার্বাইনগুলোকে সচল রাখতো। কিন্তু ব্যবস্থাটি নিরাপত্তার দিক থেকে খুব একটা ভালো ছিলো না। সাধারণত নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরের তেজস্ক্রিয়তা কমাতে পানি ব্যবহৃত হয়। নিউক্লিয়ার প্রক্রিয়াকে নিরাপদ রাখতে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা। চেরনোবিলের ক্ষেত্রে সোভিয়েতরা গ্রাফাইট ব্যবহার করেছিলো। ফলে রিঅ্যাক্টর আরো বেশি তেজস্ক্রিয় হয়ে উঠতো।
কীভাবে ঘটে চেরনোবিল দুর্ঘটনা?
১৯৮৬ সালের ২৫ এপ্রিল ৪নং রিঅ্যাক্টরের কর্মীরা নিয়মমাফিক পরীক্ষা চালাতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু ভুলবশত তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে রিঅ্যাক্টর বন্ধ হয়ে যাবার যে ব্যবস্থা, সেটি নিষ্ক্রিয় রাখেন। ২৬ এপ্রিল রাত ১টা ২৩ মিনিটে নিউক্লিয়ার ফুয়েল রডগুলো যখন পানিতে নামানো হচ্ছিলো, তখন প্রচণ্ড পরিমাণ বাষ্প উৎপন্ন হবার ফলে রিঅ্যাক্টরটি অতিরিক্ত তেজস্ক্রিয়তা লাভ করে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিষ্ক্রিয় থাকায় একের পর এক বিস্ফোরণ শুরু হয়। ৩নং রিঅ্যাক্টরেও ছড়িয়ে পড়ে এটি।
বিস্ফোরণের পর কী হয়?
দুইজন কর্মীর মৃত্যু হয় বিস্ফোরণে। তবে ক্ষতি এর চেয়েও বেশি ছিলো। প্রায় ১০ দিন ধরে বিষাক্ত পারমাণবিক উপাদান ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হয়ে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২৭ এপ্রিল প্রিপেয়াট শহরের অধিবাসীদের সরিয়ে ফেলা হয়। তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকার প্রথমে দুর্ঘটনার ক্ষয়ক্ষতির খবর যথাসম্ভব লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিলো। কিন্তু তেজস্ক্রিয়তা এত বেশি ছড়িয়ে পড়ে যে, সুইডেনে অবস্থিত ফোর্সমার্ক নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টে পর্যন্ত ধরা পড়ে এর তীব্রতা! শেষ পর্যন্ত কর্মকর্তারা দুর্ঘটনার ভয়াবহতা স্বীকার করতে বাধ্য হন।
কেমন ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে?
কয়েক সপ্তাহের মধ্যে দুর্ঘটনাস্থলে কাজ করা ২৮ জন কর্মীর মৃত্যু হয় তেজস্ক্রিয়তাজনিত কারণে। এছাড়া একইভাবে কয়েকশ মানুষ আক্রান্ত হন, যার অধিকাংশই ছিলেন ইউক্রেন, বেলারুশ ও রাশিয়ার অধিবাসী। পরবর্তীতে কয়েক হাজার ছাড়িয়ে যায় এ সংখ্যা। উদ্ধারকর্মীরাও বাদ যাননি এর প্রভাব থেকে। এখন পর্যন্ত থাইরয়েড ক্যান্সারের প্রায় ৬০০০ ঘটনাকে চেরনোবিল বিপর্যয়ের সাথে সম্পর্কিত বলে মনে করা হয়। তবে আশঙ্কার চেয়ে বাস্তবে কম ক্ষতি হয়েছে। ১৯৯০ থেকে ১৯৯১ সালের মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে প্রায় ৫০টি যৌথ ফিল্ড মিশন পরিচালিত হয় দুর্ঘটনার পুরো প্রভাব মূল্যায়নের জন্য। তবে ১৯৮৬ সালের আগের তেমন কোন তথ্য না থাকায় নির্ভরযোগ্য কোন ফলাফল পাওয়া যায় নি। ফলে এখনো বিতর্ক থেকে গিয়েছে প্রাপ্ত তথ্যের ব্যাপারে।
দুর্ঘটনার পর কী ব্যবস্থা নেয়া হয়?
১৯৮৬ সালের বিপর্যয়ের পরও চালু ছিলো চেরনোবিল নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট। ক্ষতিগ্রস্ত রিঅ্যাক্টরটি ভারি আস্তরণ দিয়ে ঢেকে ফেলা হয়। তবে এর কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে সবসময়। অন্যদিকে সক্রিয় প্ল্যান্টের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়াতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ২০০০ সালের ডিসেম্বরে এর কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়। বর্তমানে এ এলাকায় সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার সীমিত।
চেরনোবিলের তেজস্ক্রিয়তা কতদিন স্থায়ী হবে?
দুর্ঘটনার পর যে পরিমাণ তেজস্ক্রিয় উপাদান চেরনোবিল নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টের চারপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে, তার কারণে আগামী বহু বছর পর্যন্ত এলাকাটি মানুষের বসবাসের উপযোগী থাকবে না। ঠিক কত সময় পর্যন্ত এর তেজস্ক্রিয়তা স্থায়ী হবে, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে কোন সংখ্যাই কয়েকশ বছরের নিচে নয়। বর্তমানে এ অঞ্চলে যেসব বন্যপ্রাণী ও গাছ রয়েছে, তাদের দেহে সিজিয়াম-১৩৭ উপাদানের উচ্চ উপস্থিতি পাওয়া যায়।
তথ্যসূত্র
১. Chernobyl Gallery.
২. World Nuclear Association (WNA).
৩. International Atomic Energy Agency (IAEA).
৪. United Nations Scientific Committee on the Effects of Atomic Radiation (UNSCEAR).
৫. World Health Organization (WHO).