২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনের পূর্ব অংশে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পর যুদ্ধের কারণ নিয়ে হয়েছে একাধিক আলোচনা-গবেষণা ও বিশ্লেষণ। রাশিয়ার সমর্থকেরা ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্তকে দায়ী করলেও, এই যুদ্ধের গভীরতা বুঝতে আরো কিছু সমসাময়িক ও ঐতিহাসিক বিষয় ও প্রেক্ষিতকে মাথায় রাখা দরকার। বিশেষ করে, মনে রাখা দরকার যে নব্বইর দশক থেকেই ইউক্রেনের পক্ষ থেকে ন্যাটোতে যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশ করা হয়ে আসছে, এবং ইউক্রেনের বর্তমান রাষ্ট্রপতি জেলেনস্কি ২০২০ সালে ন্যাটোতে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে ২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ ক্রিমিয়া দখল করেছিল।
রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন ২০২১ সালের জুলাই মাসে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন On the Historical Unity of Russians and Ukrainians শিরোনামে যেখানে তিনি রাশিয়া, ইউক্রেন ও বেলারুশের অধিবাসীদের ঐতিহাসিক যোগসূত্রের কথা উল্লেখ করে বর্তমানে দেশ তিনটির আলাদা ও স্বতন্ত্র অবস্থানকে দুর্ভাগ্যজনক বলে উল্লেখ করেন। তিনি লেখেন,
Russians, Ukrainians, and Belarusians are all descendants of Ancient Rus, which was the largest state in Europe. Slavic and other tribes across the vast territory – from Ladoga, Novgorod, and Pskov to Kiev and Chernigov – were bound together by one language (which we now refer to as Old Russian), economic ties, the rule of the princes of the Rurik dynasty, and – after the baptism of Rus – the Orthodox faith.
এই প্রবন্ধে আমরা ভ্লাদিমির পুতিনের এই দাবির ঐতিহাসিক ভিত্তি ও রুশ জাতির উৎপত্তির ইতিহাস বোঝার চেষ্টা করবো।
লাল চুলের বণিকেরা
ভ্লাদিমির পুতিন তাঁর লেখায় লাদোগা নামে যে জায়গাটির কথা উল্লেখ করেছেন, সেখানে নবম শতকের আগে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ভাইকিংদের একটি ছোট গ্রাম গড়ে উঠেছিল, লাগোদা লেকের তীরে। সে সময় বাল্টিক সাগর থেকে ছোট ছোট নদী ও পানির প্রবাহ হয়ে কাস্পিয়ান সাগরের বন্দরগুলোতে পৌঁছানোর যে পথ ছিল, সেই পথ ধরে ভাইকিংরা সে সময়ের সবচেয়ে সমৃদ্ধ নগরী বাগদাদসহ অন্যান্য আরব নগরী ও বন্দর থেকে স্ক্যান্ডিনেভিয়াতে আসা আরব মুদ্রা দিরহামের খোঁজ পায় এবং ধীরে ধীরে আরবের সাথে বাণিজ্যে আগ্রহী হয়ে ওঠে। পূর্ব ইউরোপীয় এবং মুসলিম বিশ্বের কাছে এদের পরিচিতি ছিল রহোস বা রুস’ নামে, সম্ভবত তাদের লাল চুলের কারণে।
রুস’ সম্প্রদায়ের বণিকদের বর্ণনা পাওয়া যায় আহমদ ইবনে ফাদলানের লেখায়, যাকে পাঠানো হয়েছিল ভলগার তীরের যাযাবরদের ইসলামের রীতিনীতি সম্পর্কে জানাতে, তিনি লিখেছেন, “রুস’ সম্প্রদায় ছিল তাল গাছের মত লম্বা।” “এবং ওদের সবার হাতে থাকতো কুঠার, তরবারি ও ছুরি,” তিনি আরো যোগ করেন। স্বাভাবিকভাবেই বাল্টিক সাগর থেকে কৃষ্ণ সাগর ও কাস্পিয়ান সাগরের বন্দরে আসার এত দীর্ঘ ও দুর্যোগমত পথ পাড়ি দেয়ার জন্য দরকার ছিল প্রচণ্ড মানসিক ও শারীরিক শক্তি। তাই ভাইকিংদের মধ্যেও সবচেয়ে শক্তিশালীরাই আসতো এই পথ ধরে ব্যবসা করার জন্য।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল হিস্টোরি বিষয়ের অধ্যাপক পিটার ফ্র্যাঙ্কোপ্যান তার গবেষণার সময় দেখেছেন সেই যুগে আরবদের সাথে মোম, মধু ও অ্যাম্বারের ব্যবসা করে বিপুল পরিমাণে অর্থ নিজেদের দেশে নিয়ে গেছেন এই রুসে’রা।
তবে প্রায় তিন হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আসার জন্য যে ঝক্কি পোহাতে হত এবং যেই ঝুঁকি তাদের নিতে হত, তার জন্য এইসব পণ্যের ব্যবসা যথেষ্ট ছিল না। তাদের ছিল না কোন সোনা বা রূপার খনিও। তাই তারা মনোযোগ দেয় তখনকার দিনের অপেক্ষাকৃত লাভজনক আরেকটি ব্যবসার দিকে। মানব পাচার শুরু করে তারা।
কিয়েভান রুস’ ও দাসপ্রথা
তখনকার দিনে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দক্ষিণে আজকের বেলারুশ ও ইউক্রেনের অঞ্চলগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতেন স্লাভিক সম্প্রদায়ের মানুষ। ৮৪০ সালের পর কোন এক সময় ভাইকিংরা, যারা ইউরোপে পরিচিত ছিল রুস’ নামে, স্লাভিকদের অঞ্চলগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং ৮৬২ সালে রুরিক নামে একজন গোত্রপ্রধান একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে সেখানে। তখনকার দিনে এই অঞ্চল পরিচিতি পায় কিয়েভান রুস’ বা কিয়েভের রুস’দের দেশ নামে। এই অঞ্চলের রাজধানী হয়ে ওঠে কিয়েভ। এরাই আজকের রাশিয়ার অধিবাসী রুশদের পূর্ব পুরুষ।
কিয়েভের দখল থেকে বাগদাদসহ মুসলিম বিশ্বের সমৃদ্ধ নগরীগুলোর সাথে ক্রীতদাস বেঁচাকেনার লাভজনক ব্যবসায় যুক্ত হন কিয়েভান রুসে’রা। তাদের ‘পণ্যে’ পরিণত হতে থাকে নতুন নিয়ন্ত্রণে নেয়া এলাকাগুলোর স্লাভিক সম্প্রদায়ের মানুষেরা। পিটার ফ্র্যাঙ্কোপান লিখেছেন তখন এত বিপুল পরিমাণে স্লাভিক সম্প্রদায়ের মানুষদেরকে বন্দি করা হতো দাস হিসেবে বিক্রির জন্য যে তাদের সম্প্রদায়ের সংক্ষিপ্ত নাম স্লাভ (Slav) থেকে ইংরেজি স্লেভ (Slave) বা দাস শব্দটির উৎপত্তি হয়।
স্লাভ, এমনকি অপেক্ষাকৃত দুর্বল ভাইকিং বা রুস’দেরকেও দলে দলে নভগ্রদ, খাজারিয়া থেকে বাগদাদের বাজারে বিক্রি করা হত এবং তা থেকে বিপুল পরিমাণে লাভ করতো রুসে’রা। অপেক্ষাকৃত সুন্দর নারীদের রীতিমত নিলামে সর্বোচ্চ দামে বিক্রি করা হত বাজারগুলোতে।
তাই পুতিন যখন তাঁর প্রবন্ধে প্রাচীন রুস’দের মধ্যে ‘ঐতিহাসিক অর্থনৈতিক বন্ধন’ থাকার দাবি করেন, তিনি আসলে তখন এক চুলও মিথ্যা দাবি করেননি। বরং এই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিই পরে কিয়েভ এবং ধীরে ধীরে আরো পূর্বে গড়ে ওঠা খেরসন, নভগ্রদসহ বর্তমানে রাশিয়াতে অবস্থিত অনেক শহরকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছিল।
কিয়েভের গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় কিয়েভের রাজপরিবারের সাথে অন্য রাজপরিবারগুলোর সম্পর্ক তৈরির আগ্রহ থেকে। কিয়েভের গ্র্যান্ড প্রিন্স ইয়ারোস্লাভ দি ওয়াইজের মেয়েদের বিয়ে হয়েছিল যথাক্রমে নরওয়ে, হাঙ্গেরি, সুইডেন ও পোল্যান্ডের রাজাদের সাথে। তার ছেলেদের স্ত্রী ছিলেন যথাক্রমে পোল্যান্ডের এবং কনস্ট্যান্টিনোপোলের রাজার মেয়ে। এর আগে দশম শতাব্দীতে রাজা ভ্লাদিমির খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করে কিয়েভান রুস’ অঞ্চলে তা প্রসারের উদ্যোগ নেন।
কিয়েভান রুস’দের পতন
দৈহিকভাবে শক্তিশালী কিয়েভান রুস’দের সাম্রাজ্যের পতন হয় মঙ্গল আক্রমণের মুখে, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে। তবে তার আগেই সিংহাসনের দখল নিয়ে ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষে জড়িয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে রুসে’রা। মোঙ্গল আক্রমণ থেকে বাঁচতে একটি গীর্জায় আশ্রয় নিয়েছিলেন রাজপরিবারের সদস্যরা। মোঙ্গলরা সেই গীর্জায় আগুন ধরিয়ে দিলে সেখানেই মারা যান তারা।
সমৃদ্ধ বাগদাদ নগরীতে চড়া দামে ক্রীতদাস বিক্রির মধ্য দিয়ে যে গল্পের শুরু হয়েছিল, রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন সম্ভবত সেই গল্পের শেষ পর্বটা লিখতে চান কিয়েভান রুস’দের প্রাচীন সাম্রাজ্যকে বর্তমানে ফিরিয়ে এনে।