একটা পৃথিবী কল্পনা করুন, যেখানে আপনার প্রতিদিনের ভিটামিন-এ, বি২, বি১২, সি-এর চাহিদা মিটিয়ে দিচ্ছে আপনার সকালের রুটি বা ব্রেড। আগের রাতে আপনি ব্রেডে যে বেকার ইস্ট ব্যবহার করেছিলেন, তা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার্ড ইস্ট কোষ। এটি আপনার চাহিদার সব ভিটামিন তৈরি করতে পারে। আপনাকে কষ্ট করে বাজার থেকে মাল্টি ভিটামিন কিনে আনতে হচ্ছে না আর মাসে মাসে। এমনকি নাম মাত্র মূল্যে ভ্যানিলা ফ্ল্যাভার বা স্ট্রবেরি ফ্ল্যাভার তৈরি করতে পারছেন এ ইস্ট কোষ থেকে। অথবা আপনি সুগন্ধি শৌখিন? ঘরে বসেই নিজের ইস্ট কোষের কালচার থেকে নিজের পছন্দ অনুযায়ী সুগন্ধি বানাচ্ছেন আপনি। কিংবা আপনার গাড়ি চলছে বায়ো-ডিজেলে। সস্তা এ জ্বালানি আমাদের খনিজ তেলের উপর নির্ভরশীলতা নামিয়ে এনেছে শূন্যতে। বাংলাদেশই হয়তো জৈবিক ও কৃষিজাত উচ্ছিষ্ট থেকে তৈরি বায়োডিজেল রপ্তানি করছে বিদেশে। আপনার ডিএনএ বা জেনেটিক ম্যাপের উপর ভিত্তি করে ব্যক্তিগত ওষুধ তৈরি হয়ে যাচ্ছে বাড়িতেই! ক্যান্সার প্রতিরোধে কাজ করছে জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ার্ড ভাইরাস। অথবা অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে হয়তো আপনাকে আর রোগ জীবাণু মারতে হচ্ছে না; বরং তাদের রোগ সৃষ্টির ক্ষমতা অকার্যকর করে দিয়ে তাদেরকে ব্যবহার করছেন সুস্বাস্থ্যের জন্য বা প্রোবায়োটিক হিসেবে!
উপরের কোনটাই অতিবাস্তব বা কল্পনা নয়। এমন ঘটনা অহরহ ঘটিয়ে চলছে বায়োটেকনোলজি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনার ফ্রন্টিয়ার বলে বিবেচিত সিন্থ্যাটিক বায়োলজির (Synthetic Biology) ছাত্র ও গবেষকরা।
একটুখানি সিন্থ্যাটিক বায়োলজি
সিন্থ্যাটিক বায়োলজি বা সংক্ষেপে সিনবায়োর সাথে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সবচেয়ে বড় পার্থক্য সহজ ভাষায় বলা যাক। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং সীমাবদ্ধ ছিলো প্রাণের জেনেটিক কোডগুলোকে “কাট-কপি-পেস্ট” প্রক্রিয়ার মধ্যে। কিন্তু মূল জেনেটিক কোডে কোন পরিবর্তন (Edit) করা সম্ভব ছিলো না। সিন্থ্যাটিক বায়োলজি এ অসাধ্য সাধন করেছে। একটা উদাহরণ দিই। ভিটামিন-এ পাওয়া যায় গাঁজর বা মিষ্টি কুমড়ায়। এ ভিটামিন তৈরির জন্য গাছগুলোর যে জিন দায়ী, তা বিজ্ঞানীরা ইস্ট কোষে দিয়ে দিলেই কোষটি ভিটামিন-এ তৈরি করে দেবে না। কারণ ভিটামিন-এ তৈরির জেনেটিক কোড ওই নির্দিষ্ট গাছগুলোর জন্য প্রাকৃতিকভাবে বিবর্তনের ধারায় তৈরি হয়েছে। ফলে ইস্টের মতো ছত্রাক কোষের জন্য সে কোড উপযোগী নয়। সিনবায়োর কাজ তার কোড “এডিট” করা। এমনকি এ ভিটামিন উৎপাদনে যে মেটাবলিক পাথওয়ে ব্যবহার করা হয়েছে, সে পাথওয়েকেও সিনবায়োর মাধ্যমে ছোট বা কার্যকরী করে নিয়ে আসা সম্ভব। এ বছর (২০১৫) চীনের বিজ্ঞানী তু ইউইউকে (Tu Youyou) মেডিসিনে নোবেল দেয়া হয় ম্যালেরিয়া রোগের সবচেয়ে কার্যকারী ওষুধ আর্টেমেসিনিন আবিষ্কারের জন্য। ওষুধটি একসময় বেশ ব্যয়বহুল হওয়ায় আক্রান্ত রোগীরা লাভবান হতে পারছিলেন না। কিন্তু ২০০৬ সালে সিনবায়ো বিজ্ঞানীরা ইস্টের কোষকে জেনেটিক্যালি মোডিফাই করে আর্টেমেসিনিন উৎপাদন করে এ ওষুধের দাম নামিয়ে এনেছেন দরিদ্র মানুষের হাতের নাগালে।
আইজেম (iGEM)
২০০৩ সাল থেকে প্রতি বছর বায়োটেক জগতে যুগান্তকারী সিন্থ্যাটিক বায়োলজি ফিল্ডের অগ্রযাত্রার নেতৃত্ব দিচ্ছে ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির (MIT) হাত ধরে শুরু হওয়া এ বিষয়ের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগিতা আইজেম (iGEM) বা ইন্টারন্যাশনাল জেনেটিক্যালি মোডিফাইড ম্যাশিন্স (International Genetically Engineered Machines)। প্রতি বছর গ্রীষ্মকালে সারা বিশ্বের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সিন্থ্যাটিক বায়োলজির শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে নামে। হাই স্কুল, আন্ডারগ্রেড, ওভারগ্রেড বা স্বাধীন কমিউনিটি ল্যাব ক্যাটাগরিতে অনুষ্ঠিত হয় এ প্রতিযোগিতা। ২৪ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে অনুষ্ঠিত আইজেম ২০১৫ আসরে ৩০ টি দেশের ২৮০ টি দল অংশগ্রহণ করেছিলো। সবার একটাই উদ্দেশ্য – পরিবেশ দূষণ, খাদ্য-পুষ্টি, রোগ বালাই প্রতিরোধ, জ্বালানি সমস্যার মতো নানা জটিল সমস্যার যুগান্তকারী সমাধান সিনবায়োর মাধ্যমে নিয়ে আসা।

আমার সৌভাগ্য হয়েছিলো এ বছরের প্রতিযোগিতায় ফ্রান্সের সবচেয়ে বড় দল প্যারিস বেতেনকোর্ট আইজেম ২০১৫ দলের একজন সদস্য হয়ে অংশগ্রহণ করার। দলটি মূলত ফ্রান্সের সিনবায়োর প্রাণকেন্দ্র বলে পরিচিত সেন্টার ফর রিসার্চ এন্ড ইন্টারডিসিপ্লিনারিটির (সংক্ষেপে “ক্রি”) সিনবায়ো প্রোগ্রামের অনার্স ও মাস্টার্সের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে গঠিত। আমাদের জন্য আইজেম প্রতিযোগিতা সামার রিসার্চ ইন্টার্নশিপ হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়। প্যারিস বেতেনকোর্ট আইজেম ফ্রান্সের প্রথম ও সবচেয়ে সুপরিচিত আইজেম দল। ২০১৩ সালে আইজেম গ্রান্ড চ্যাম্পিয়ান হবার গৌরবও রয়েছে এ দলের।
আমার অভিজ্ঞতা
প্যারিস বেতেনকোর্ট আইজেম ২০১৫ দলের মূল লক্ষ্য ছিলো ভিটামিন নিয়ে কাজ করার। বিশ্বের ভিটামিন অভাব কীভাবে মোকাবেলা করা যায়, তা নিয়ে এ পর্যন্ত বহু গবেষণা হয়েছে। এর মধে একটি হলো ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ গোল্ডেন রাইস। বিশ্বব্যাপী বির্তক ও প্রজেক্টের স্থানীয় গ্রহণযোগ্যতা কম থাকায় তা খুব একটা সফলতার মুখ দেখতে পারেনি। ব্যাপারটা আমাদের মাথায় ছিলো। ভিটামিনের অভাব নিয়ে রিসার্চ পেপার আর রিভিউ ঘাটাঘাটি করে বিশ্বের যেসব ভৌগোলিক দেশ চিহ্নিত করা হয়, সেগুলোর মধ্যে ছিলো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো। আমরা ভাবছিলাম কীভাবে দেশজ প্রযুক্তি ও কালচারকে বিজ্ঞানের সাথে এক করে একটা বাস্তবিক (ও প্রায়োগিক) সমাধান আনা যায়। জানা গেলো, দক্ষিণ ভারতে চাল ও ডালের গুড়ার ফ্যাটানো কাই বা ব্যাটার (Batter) রাতব্যাপী গাঁজনের (Fermentation) মাধ্যমে পরের দিন ইডলি, দোসাসহ নানা রকমের মুখরোচক খাবার বানানো হয়। আমরা আমাদের ইউরেকা মুহূর্ত পেয়ে গেলাম! গাঁজন প্রক্রিয়ার পুরোটাই সে খাবারে অবস্থিত অণুজীবদের দ্বারা ঘটে থাকে। সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, যেসব ভিটামিনের অভাব ওই অঞ্চলে রয়েছে, ইডলি-দোসার রেসিপির ভাত-ডাল পাঁচনে দায়ী এই অণুজীবদের “মেটাবলিক ইঞ্জিনিয়ারিং” করে সেসব ভিটামিন পাথওয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
চার মাসের পরিশ্রমের পর আমরা ভিটামিন-এ ও ভিটামিন-বি১২ উৎপাদনকারী অণুজীগুলোকে ইডলি-দোসা পেস্টের মাইক্রোবায়োমে সফলভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি। এছাড়া আরেকটি অনুজীব কোষে ভিটামিন বি২-এর মেটাবলিক ইঞ্জিনিয়ারিং করতে সক্ষম হই। আমাদের প্রজেক্টের নাম ছিলো ফার্মেন্ট ইট ইউরসেলফ (Ferment it Yourself)। এ প্রজেক্ট নিয়ে প্যারিস বেতেনকোর্ট আইজেম ২০১৫ দল স্বর্ণপদক জেতে।

ভবিষ্যতের পথে
সিনবায়োভিত্তিক অসাধারণ আইজেম প্রতিযোগিতা দিন দিন বড় হচ্ছে। গবেষকদের ল্যাবের গণ্ডি পেরিয়ে সিন্থ্যাটিক বায়োলজির অপরিসীম সম্ভাবনা অনুধাবন করেছে পশ্চিমা দেশের সরকারগুলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি ও চীনের মতো দেশগুলো এ ফিল্ডের গবেষণায় সরকারি অনুদান প্রতি বছর বাড়িয়েই চলছে। ২০১২ সালে যুক্তরাজ্য সিন্থ্যাটিক বায়োলজি রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। তারা প্রত্যাশা করছে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের জ্বালানি সমস্যা, রোগ প্রতিরোধ ও খাদ্য পুষ্টি সমস্যা সমাধানে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবার।
বিংশ শতাব্দী ছিলো তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের জন্য সেরা সময়। একবিংশ শতাব্দীকে বলা হয় লাইফ সায়েন্সের অগ্রযাত্রার। আশা করি, বাংলাদেশের সরকার বায়োটেক গবেষণার অসীম সম্ভাবনাকে অনুধাবন করে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা অনুদান বাড়াবে ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষায় বায়োটেকের সাথে আগামী দিনের বিজ্ঞানী ও উদ্যোক্তাদের পরিচয় করিয়ে দিবে। হয়তো কয়েক বছর পর আইজেমের বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশি পতাকাও দেখা যাবে!
শব্দজব্দ
বায়োডিজেল: জৈবিক উৎস থেকে যে তেল পাওয়া যায়।
মেটাবলিক পাথওয়ে: কোষে কোন বস্তু উৎপাদনে ধাপে ধাপে নানা রকম জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। প্রতিটি ধাপে নির্দিষ্ট এনজাইম কাজ করে এ কাজ করার জন্য।
ফার্মেন্টেশন: এ প্রক্রিয়ায় ব্যাকটেরিয়া, ইস্ট বা অন্যান্য অণুজীব জৈব রাসায়নিক উপায়ে কোন পদার্থকে (মূলত কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা জাতীয় খাবারকে) ভেঙে এসিড, গ্যাস ও অ্যালকোহলে রূপান্তরিত করে বিপাক বা রাসায়নিক বিক্রিয়ার উপযোগী করে তোলে।
মেটাবলিক ইঞ্জিনিয়ারিং: জৈব প্রযুক্তির মাধ্যমে কোষের জেনেটিক ও বিপাকীয় ব্যবস্থার (মেটাবলিক পাথওয়ে) পরিবর্তন এনে কোষকে কোন নতুন পদার্থ উৎপাদনে বা বিদ্যমান পদার্থের উৎপাদন বাড়াতে উপযোগী করে গড়ে তোলা।
মাইক্রোবায়োম: কোন একটি নির্দিষ্ট পরিবেশে বিভিন্ন প্রকার অনুজীবের সমষ্টি।
বিস্তারিত তথ্য
১. আইজেম
২. আইজেম ২০১৫
৩. প্যারিস বেতেনকোর্ট আইজেম ২০১৫ দল
৪. সেন্টার ফর রিসার্চ এন্ড ইন্টারডিসিপ্লিনারিটি
৫. সাজ্জাদ হোসেন মুকিত: আইজেম ২০১৫
লেখকের সাথে যোগাযোগের ইমেইল: shazzad.hossain@ymail.com