ফিলিস্তিনে বিংশ থেকে একবিংশ শতাব্দী, প্রায় শত বছর ধরে চলছে সংকট। ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হওয়া এই সংকট ওলটপালট করে দিয়েছে লাখো মানুষের জীবন জীবিকাসহ সম্পূর্ণ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি।
তবে ফিলিস্তিন মানে কি শুধুই ফাতাহ অথবা হামাস? না।
অন্য অধিকাংশ দেশের মতই ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক এবং সশস্ত্র সংগ্রামী দলগুলোর মধ্যেও রয়েছে বৈচিত্র্য। চলুন দেখে নেওয়া যাক ফিলিস্তিনের বিভিন্ন সংগ্রামী গোষ্ঠীর ইতিবৃত্ত।
ফাত্হ
আরবি শব্দ ফাতাহ বা ফাতিহ অর্থ হচ্ছে বিজয় অর্জন করা। ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক ও সামরিক সংগঠনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরনো ফাতাহ জন্ম নেয় ১৯৫৯ সালে ইয়াসির আরাফাত, খালেদ ইয়াসরুতি, খলিল আল ওয়াজির, সালাহ খালাফ প্রমুখ ব্যক্তিদের হাত ধরে। তখন সংগঠনটির নাম ছিল হারকাত আত-তাহরির আল-ফিলিস্তিনিয়া, অর্থাৎ ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য জাতীয় আন্দোলন। মূল নামটি উলটো করে প্রথম অক্ষরগুলো নিয়ে সাজালে হয় ফাত্হ।
ফাত্হ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে পরিচিত। ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে এক সময় জর্ডানের দখলে থাকা অংশে সংগঠনটির মূল কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। কারেমেহতে ইসরাইল সেনাবাহিনীর সাথে সশস্ত্র লড়াই, লেবাননের গৃহযুদ্ধ, ছয় দিনের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ, প্রথম ইন্তিফাদার মত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহে ফাত্হ সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়।
১৯৬৪ সালে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী প্রগতিশীল সংগঠনদের জোট প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) গঠিত হলে সেখানে যোগ দেয় ফাত্হ এবং ১৯৬৯ সালে ফাত্হ’র প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নেতা ইয়াসির আরাফাত পিএলও’র প্রধান হন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইয়াসির আরাফাত ফাত্হ’র প্রধান ছিলেন।
ফাত্হ’র বর্তমান প্রধান মাহমুদ আব্বাস বর্তমানে পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিন প্রশাসনের প্রধান। ২০০৬ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর থেকে গাজা উপত্যকায় নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় সংগঠনটি। ফাত্হ ফিলিস্তিনে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান এবং ইসরায়েলের সাথে সহাবস্থানে রাজি হয় ১৯৬৭ সালের সীমানা অনুসারে।
প্যালেস্টিনিয়ান লিবারেশন ফ্রন্ট (পিএলএফ)
স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠার দাবি আদায়ে বিমান ছিনতাইসহ বিভিন্ন সহিংস কর্মকাণ্ডের জন্য প্যালেস্টাইন লিবারেশন ফ্রন্ট (পিএলএফ) সত্তর থেকে আশির দশকে বেশ পরিচিতি পেয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা দপ্তরের মতে পিএলএফ ১৯৬১ সালে সিরীয় সেনাবাহিনীতে কর্মরত আহমেদ জিব্রিল নামে একজন ফিলিস্তিনি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮৪ সাল থেকে সংগঠনটি তিনটি উপদলে বিভক্ত হয় যাদের সবক’টি পিএলএফ নাম ব্যবহার করে আসছে। তবে ২০১০ সাল থেকে সংগঠনটিকে তেমন সক্রিয় দেখা যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও জাপান পিএলএফকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।
পপুলার ফ্রন্ট ফর লিবারেশন অফ প্যালেস্টাইন (পিএফএলপি)
বিমান ছিনতাইকারী লায়লা খালেদ এবং সাহিত্যিক ঘাসান কানাফানির মতো বিখ্যাত ব্যক্তিদের কারণে এই সংগঠনটি পরিচিতি পেলেও পিএফএলপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জর্জ হাবাশ, ১৯৬৭ সালে। সাম্যবাদী মার্ক্সিস্ট-লেলিনিস্ট ধারায় পরিচালিত এই সংগঠনটি ফাত্হ’র দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান প্রত্যাখান করে এবং এমন একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে যেখানে সব ধর্মের মানুষ কোন বৈষম্য ছাড়া বসবাস করতে পারবে।
পিএফএলপির সশস্ত্র সংগঠনের নাম আবু আলি মুস্তফা ব্রিগেড। ইরানের ইসলামিক রিপাবলিকান গার্ড কোরের ঘনিষ্ঠ এই সংগঠনটিকে যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি দেশ সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।
ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট ফর লিবারেশন অফ প্যালেস্টাইন (ডিএফএলপি)
পিএফএলপির একটি অংশ দুই বছর পর ডিএফএলপি গঠন করে নায়েফ হাওয়াতমেহ’র উদ্যোগে। ডিএফএলপি ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক জোট পিএলও’র সদস্য। সংগঠনটির সশস্ত্র অংশের নাম ন্যাশনাল রেজিস্ট্যান্স ব্রিগেডস। সংগঠনটি গাজা উপত্যকাতেও সক্রিয় রয়েছে। কথিত আছে সংগঠনটি সিরিয়া সরকারের সহায়তা পেয়ে থাকে এবং এক সময় লিবিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ঘনিষ্ঠ ছিল।
প্যালেস্টিনিয়ান ইসলামিক জিহাদ
ফিলিস্তিনে ইসলামি জিহাদ আন্দোলন, আরবিতে হারাকাত আল-জিহাদ আল-ইসলামি ফি ফিলিস্তিন, বা সহজ ভাষায় ফিলিস্তিনের ইসলামি জিহাদ হচ্ছে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকাভিত্তিক ইসলামপন্থী একটি রাজনৈতিক সংগঠন যা গড়ে ওঠে ১৯৮১ সালে। সংগঠনটি সশস্ত্র শাখার নাম আল-কুদস ব্রিগেড।
যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি দেশ সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে পিআইজেকে।
হামাস
আরবি শব্দ হামাস অর্থ সংকল্প বা উদ্যম। ফাত্হ’র মত হামাস নামটিও এসেছে একটি লম্বা আরবি নামের সংক্ষিপ্ত রূপ থেকে। হারাকাহ আল-মুকাওয়ামাহ আল-ইসলামিয়াহ্, যার বাংলা অর্থ ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন, থেকে হামাস শব্দটি এসেছে।
১৯৮৭ সালে প্রথম ইন্তিফাদার সময় গাজা উপত্যকায় ইমাম শেখ আহমেদ ইয়াসিন এবং সহযোগী আব্দুল আজিজ আল-রান্তিসি প্রতিষ্ঠা করেন হামাস। যদিও হামাস মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডের ঘনিষ্ঠ হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল, বর্তমানে তারা মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। পিএলও’র সংগঠনগুলো, যেমন ফাত্হ, পিএফএলপি এবং ডিএফএলপি’র মত হামাস ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল সংগঠন হিসেবে নয়, বরং ইসলামি মূল্যবোধের আলোকে নিজেদের পরিচালিত করার দাবি করে।
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য আল-কাসাম ব্রিগেড নামে একটি সামরিক সংগঠন রয়েছে হামাসের। ২০১৭ সালে সংগঠনটি ১৯৬৭ সালের সীমানারেখা মেনে নেয়ার কথা জানায়।