চলচ্চিত্র এমন এক মাধ্যম যা মানুষকে যুগ-যুগান্তরের পরিবেশ-পরিস্থিতিকে অনুভব করতে শেখাতে পারে, অনেকটা সময় ভ্রমণের মত করে। চলচ্চিত্রের সাহায্যেই আমরা অর্থ্যাৎ নতুন প্রজন্ম অনুধাবন করতে পারি কেমন ছিল পুরানো যুগ, বিশেষত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রগুলোর চিত্রায়ণ যেন আমাদের নিমিষেই নিয়ে যায় একাত্তরের সময়টায়। মুক্তিযুদ্ধকে অবলোকন না করেও এর ভয়াবহতার চিত্রিত গল্পগুলো নাড়া দিয়ে যায় আমাদের মনকে।
তবে সব চলচ্চিত্রই যে মনে দাগ কেটে যায়, যুগের বেশির ভাগের কাছে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে তা কিন্তু নয়। আর তাই আজ ২৬শে মার্চ, মহান স্বাধীনতা দিবসে এক পলকে দেখে আসা যাক মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত এমন কিছু চলচ্চিত্র সম্পর্কে যেগুলো দেশের সর্বোচ্চ সম্মান তথা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের মঞ্চে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
মেঘের অনেক রং (১৯৭৬)
১৯৭৫ সাল থেকে বাংলাদেশে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিতরণীর শুরু, যদিও তা প্রদান করা হয়েছিল ১৯৭৬ সালে। একই বছর আরও একবার অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, আর তখনই “মেঘের অনেক রং” নির্বাচিত হয় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বিভাগে।
মাত্র ৭৮ মিনিটের এ চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছিলেন হারুনর রশীদ, অভিনয়ে ছিলেন মাথিন, রওশন আরা, ওমর এলাহী, আদনান, উচিংমা, জয়ন্তী প্রমুখ। এই চলচ্চিত্রের মূল উপজীব্য ছিল যুদ্ধে নারীর উপর আক্রমণ, শ্লীলতাহানি এবং তার পরিক্রমায় নারীর জীবনে নেমে আসা অন্ধকার, যে অন্ধকার শুধু নারীকেই নয় বরং আশপাশের নানান মানুষকেই আহত করেছে। এই চলচ্চিত্রের একটি ভিন্নধর্মী আবেদন রয়েছে, যা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এক পাহাড়ি নারীর অভিনয়ের মাধ্যমে। পরিচালক হারুনর রশীদ রাঙামাটি থেকে মাথিনকে নিয়ে আসেন এই দৃশ্যপটের পূর্ণতাদানের জন্য। এর বাইরেও এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় রঙিন চলচ্চিত্র।
আগুনের পরশমনি (১৯৯৪)
১৯তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ৮টি বিভাগে পুরস্কার জিতে নেয়া হুমায়ুন আহমেদ পরিচালিত একটি অসাধারণ চলচ্চিত্র আগুনের পরশমনি, যা তাঁর লেখা বই অনুসরণেই নির্মিত। এ চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে এক মধ্যবিত্ত পরিবারের চোখে মুক্তিযুদ্ধের আতংক আর বীভৎসতা ফুটে উঠেছে। এই চলচ্চিত্রে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ঢাকায় ক্র্যাক প্লাটুনের অভিযান।
আবুল হায়াত, আসাদুজ্জামান নূর, বিপাশা হায়াত, ডলি জহুর, দিলারা জামান, লুৎফর রহমান জর্জ প্রভৃতি গুণ্যমান্য শিল্পীদের অনবদ্য অভিনয় এ চলচ্চিত্রকে জীবন্ত করে তুলেছে। উল্লেখ্য যে হুমায়ুন কন্যা শীলা আহমেদ এই চলচ্চিত্রেই অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পীর পুরস্কার জিতে নিয়েছিলেন, আর জিতে নিয়েছিলেন মানুষের মন। ১২৩ মিনিটের এই চলচ্চিত্র থেকে যেন মানুষের চোখ সরানোও অসম্ভব, এতটাই অমলিন এই চলচ্চিত্র।
জয়যাত্রা (২০০৪)
নক্ষত্র চলচ্চিত্র আর ইমপ্রেস টেলিফিল্মের যৌথ প্রযোজনায় ২০০০’র দশকের প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র হিসেবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বিভাগে জাতীয় পুরস্কার গ্রহণ করে তৌকির আহমেদ পরিচালিত জয়যাত্রা। এটি তৌকির আহমেদের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। মূলত মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে ভয়ে-আতঙ্কে গ্রামের দিকে পালিয়ে যেতে শুরু করা একদল সাধারণ মানুষের হাসি-কান্না আর সুখ-দুঃখ মেশানো গল্প ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এ চলচ্চিত্রে।
হুমায়ুন ফরীদি, আবুল হায়াত, বিপাশা হায়াত, তারিক আনাম খান, মাহফুজ আহমেদ, আজিজুল হাকিম, মেহবুবা মাহনূর চাঁদনীর মত দাপটে অভিনয়শিল্পীরাই ১১৯ মিনিটের এই চলচ্চিত্রকে নিয়ে যায় অন্য মাত্রায়।
গহীনে শব্দ (২০১০)
ইমপ্রেস টেলিফিল্মের প্রযোজনায় আবুল হায়াত, কুসুম শিকদার, ইমন প্রভৃতি শিল্পীর অভিনয়ে ২৫তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের মঞ্চে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে জায়গা করে নেয় এই চলচ্চিত্রটি। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বাদেও দেশি-বিদেশি নানান পুরস্কার অর্জন করেছে এই সিনেমাটি। অন্যান্য চলচ্চিত্রের সাথে “গহীনে শব্দ” এর একটি পার্থক্য রয়েছে, এটিতে মুক্তিযুদ্ধকালীন চিত্র নয় বরং এর পরবর্তীকালে রাজাকারদের আক্রমণে পা হারানো এক মুক্তিযোদ্ধার আর তার সন্তানের জীবনের গল্প উঠে এসেছে। উল্লেখ্য যে, এই চলচ্চিত্রটি ২০১০ সালের ২৬শে মার্চেই প্রথম মুক্তি পায়।
গেরিলা (২০১১)
গহীনে শব্দ চলচ্চিত্রটির পরের বছরই মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে আরও একটি চলচ্চিত্র দর্শকমন্ডলীর মন জিতে নেয়, আর তা হল নাসির উদ্দীন ইউসুফ পরিচালিত “গেরিলা”। এই চলচ্চিত্রটির আখ্যান সৈয়দ শামসুল হক রচিত “নিষিদ্ধ লোবান” নামক উপন্যাস থেকে নেয়া হয়েছে। ২৫শে মার্চের অন্ধকার রাতে নিখোঁজ হওয়া সাংবাদিক হাসানের স্ত্রী বিলকিসের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া নিয়েই এই চলচ্চিত্র।
এক ঘণ্টা ২০ মিনিটের এই চলচ্চিত্রকে জয়া আহসান, ফেরদৌস আহমেদ, এটিএম শামসুজ্জামান, রাইসুল ইসলাম আসাদ, পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়, শম্পা রেজা, আহমেদ রুবেল, গাজী রাকায়েত প্রমুখ তাঁদের অভিনয়শৈলী দ্বারা নিয়ে গিয়েছেন অন্য এক মাত্রায়। বিশেষত নেতিবাচক চরিত্রে শতাব্দী ওয়াদুদ যেন তার শ্রেষ্ঠ অভিনয়টিই উপহার দিয়েছেন দর্শকদের। ২০১১ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে দশটি শাখায় পুরস্কার ছাড়াও এই চলচ্চিত্রের ঝুলিতে রয়েছে নানান আন্তর্জাতিক পুরস্কার।
নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ (২০১৪)
গীতিকার ও কবি মাসুদ পথিকের পরিচালনায় নির্মলেন্দু গুণের কবিতা থেকে অনুপ্রাণিত এ চলচ্চিত্র মুক্তি পায় ২০১৪ সালের ২০শে জুন। মুক্তিযুদ্ধে প্রেমিকা আর পা-উভয়ই হারানো নেকাব্বর নামক এক ব্যাক্তিকে কেন্দ্র করেই এই চলচ্চিত্রের মূল গল্প। যদিও এই চলচ্চিত্রটি প্রথমে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বাদে পাঁচটি শাখায় পুরস্কার পেয়েছিল। কিন্তু ঐ বছর প্রাথমিকভাবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে মনোনীত হওয়া চলচ্চিত্র “বৃহন্নলা” এর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত হলে এই চলচ্চিত্রের হাতে এই শাখার পুরস্কারটিও যোগ হয়।
শিমলা, মামুনুর রশীদ, জুয়েল জহুর, প্রবীর মিত্র এ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এর বাইরে নির্মলেন্দু গুণসহ আরো ১৫জন কবির উপস্থিতি এ চলচ্চিত্রকে অনন্য করে তোলে।
অনিল বাগচীর একদিন (২০১৫)
৪০তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের “শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র” শাখায় দুটি চলচ্চিত্র পুরস্কার জয় করে নেয়, তার মধ্যে এই অনিল বাগচীর একদিন একটি। একই নামে হুমায়ুন আহমেদের একটি উপন্যাস আছে, এর অবলম্বনেই মোরশেদুল ইসলাম এ চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছিলেন। সিনেমার পর্দায় দুই ঘণ্টার এক ঝলকে উপন্যাসটি যেন পরিপূর্ণ সার্থকতা পায়। এর শ্রেষ্ঠাংশে ছিলেন গাজী রাকায়েত, জ্যোতিকা জ্যোতি, ফারহানা মিঠু, মিশা সওদাগর প্রমুখ। মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেন আরেফ সৈয়দ। শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ক্যাটাগরিটি ছাড়াও এই চলচ্চিত্রের ঝুলিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের আরও পাঁচটি ক্যাটাগরির পুরস্কার আছে।
লাল মোরগের ঝুঁটি (২০২১)
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র, যা আবার জয় করে নিয়েছে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, এমন চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে এখনও পর্যন্ত সর্বশেষ সংযোজন লাল মোরগের ঝুঁটি। ২০২১ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে এটি আর নোনা জলের কাব্য যৌথভাবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়। বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে এই চলচ্চিত্রের কাহিনীর সূচনা একাত্তরের প্রেক্ষাপটে সৈয়দপুরে। পর্দায় সদ্যপ্রয়াত আহমেদ রুবেল, ইলোরা গহর, জ্যোতিকা জ্যোতি, আশনা হাবীব ভাবনার সপ্রতিভ উপস্থিতি চলচ্চিত্রটিকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে। এর কাহিনি, সংলাপ, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা করেছেন নুরুল আলম আতিক।
শুধু জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হওয়ার মানদণ্ডেই নয়, স্বাধীনতার ৫৩ বছরে এসেও মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা, ত্যাগ, অর্জন সবকিছুর এক উপলব্ধি জনসাধারণের কাছে তুলে ধরতে সার্থক এই চলচ্চিত্রগুলো। হয়তো বিশ্বমহলে যারা অবগত নয় তাদের কাছেও নানান দিক থেকে স্বাধীনতা অর্জনের প্রামাণ্য ইতিহাস তুলে ধরবে এই চলচ্চিত্রগুলো, গর্বিত করবে আমাদের।