কিছুটা অগোচরেই আরব বিশ্বে চলছে ‘ঠাণ্ডা যুদ্ধ’, যার এক পক্ষে আছে সৌদি আরব, অপরপক্ষে ইরান। দুই দেশের অনুগত বাহিনীগুলো একে অপরের সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছে সিরিয়া, ইয়েমেন ও ইরাকে। যুদ্ধে সরাসরি না জড়ালেও এ সংঘাতে লেবানন, জর্ডান, পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং লিবিয়ার যোদ্ধাদেরও সম্পৃক্ততা আছে। এ সংঘাতকে নতুন রূপ দিয়েছে ২০১০ দশকজুড়ে আরব ও ভূমধ্যসাগরীয় বিভিন্ন দেশে ঘটে যাওয়া সরকারবিরোধী আন্দোলনগুলো, যাকে আমরা জানি আরব বসন্ত নামে। অন্যদিকে আরব বিশ্বের প্রায় সব দেশের জাতীয় শত্রু হিসেবে পরিচিত ইসরাইলও জড়িয়ে গেছে এতে।
এ লেখায় উল্লেখ করা হয়েছে এমন পাঁচটি প্রামাণ্যচিত্রের কথা যা, আরব বিশ্বে গত প্রায় ত্রিশ বছর ধরে চলা ঠাণ্ডা যুদ্ধ, দেশে দেশে সংঘাত, শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব ইত্যাদি বিষয়গুলো জানতে সাহায্য করবে।
০১) বিটার রাইভালস – ইরান অ্যান্ড সৌদি অ্যারাবিয়া
সাংবাদিক ও মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ মার্টিন স্মিথের অনবদ্য কাজগুলোর একটি এ প্রামাণ্যচিত্র। মধ্যপ্রাচ্যের দুই দেশ ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যকার দ্বন্দ্বের সূত্রপাত থেকে এখন পর্যন্ত চলা সব সংকটের একটা ধারণা পাওয়া যাবে এখান থেকে।
প্রামাণ্যটি দুই পর্বের। প্রথম পর্বে দেখানো হয়েছে ইরানের ইসলামি বিপ্লব থেকে কীভাবে পুরো আরব বিশ্বের দৃশ্যপট পাল্টাতে শুরু করে, কীভাবে সৌদি আরব জড়িয়ে পড়ে এ সংকটে, ইরাক-ইরান যুদ্ধে ইরাক ও বিশ্বের দায়, সাদ্দাম হোসেনের হঠকারিতা ও বিদায়, আফগানিস্তানে সৌদি-মার্কিন জোটের মদদে পাকিস্তানের জড়িয়ে পড়া এবং ওয়াহাবি মতবাদের প্রসার ইত্যাদি।
দ্বিতীয় পর্বে আছে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ ও ইরাকে আইএসআইএসের উত্থান থেকে ইরানের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া, লেবাননের হিজবোল্লাহ বাহিনীর অবস্থান, ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহীদের দমনের নামে সৌদি আরবের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া, জাতিসংঘ ঘোষিত ভয়াবহ মানব দুর্যোগ ইত্যাদি।
০২) পিএলও: হিস্টোরি অফ আ রেভ্যুলুশন
স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন নিয়ে প্রামাণ্যচিত্রটি তৈরি করেছে আল-জাজিরা। এতে উঠে এসেছে ফিলিস্তিনের অবিসংবদিত নেতা ইয়াসির আরাফাতের জীবন, প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) প্রতিষ্ঠা, আরব-ইসরাইল যুদ্ধ, লেবানন থেকে যুদ্ধ পরিচালনা, জর্ডানের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়া, মার্কিন মধ্যস্ততায় শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর ইত্যাদি।
সাধারণত মুসলিম ও আরব বিশ্বে ইয়াসির আরাফাত বীরের মর্যাদা পান। তাঁর ভুলগুলো নিয়ে খুব কম আলোচনা হয়। এ প্রামাণ্যচিত্রে ইয়াসির আরাফাত ও পিএলওর সংগ্রামের পাশাপাশি হঠকারি কর্মকাণ্ডগুলোও উঠে এসেছে, যার মাশুল তাঁদের এখনো দিতে হচ্ছে।
প্রামাণ্যচিত্রটি মোট ছয় পর্বের – মাস্টারস অফ দেয়ার ওউন ডেস্টিনি, ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর, উইন্ডস অফ হেভেন, দি গ্রেট সারভাইভার, ইন্তিফাদা, ডেথ অ্যান্ড ডিক্লাইন।
০৩) হাউজ অফ সৌদ
সৌদি আরব, দাপ্তরিক নাম কিংডম অফ সৌদি আরব। নিজেদের ‘কিংডম’ দাবি করা রাষ্ট্রটি জন্মলগ্ন থেকেই পরিচালিত হয়ে আসছে একটি পরিবার দ্বারা যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রাজা আব্দুল আজিজ। পশ্চিমে তিনি ইবনে সৌদ নামেই পরিচিত। রাজা আব্দুল আজিজ ছিলেন মুহাম্মাদ ইবনে সৌদের বংশধর। এ বংশের নামেই রাষ্ট্রটির নাম সৌদি আরব।
ইসলামের দুইটি গুরুত্বপূর্ণ শহর মক্কা ও মদীনার অবস্থানের কারণে মুসলিম বিশ্বের, বিশেষ করে সুন্নি মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্রগুলোর নেতৃত্বে আছে সৌদি আরব। তবে এ নেতৃত্ব বারবার চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। মিশরের জামাল আবদেল নাসের থেকে ইরানের খোমেনি পর্যন্ত অনেক নেতাই তাঁদের নেতৃত্ব মেনে নেননি।
এছাড়াও ফিলিস্তিন ইস্যুতে ব্যর্থতা, আরব-ইসরাইল যুদ্ধে পরাজয়, সাদ্দাম হোসেনকে সহায়তা দেয়া, মুসলমানদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কট্টর শক্তিগুলোকে মদদ দেয়া, ওয়াহাবি মতবাদের প্রসারে অর্থব্যয় যার ফলশ্রুতিতে টুইন টাওয়ার হামলাসহ বিভিন্ন জঙ্গি কার্যক্রমে সৌদি নাগরিকদের জড়িত থাকা ইত্যাদি বিভিন্ন ঘটনায় বিতর্কিত হয়েছে দেশটি। কিন্তু বিপুল পরিমাণ তেলের মজুদ এবং ইসলামের দুইটি পবিত্রতম স্থানের অবস্থান তাদেরকে এমন বহু বিতর্ক কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে।
প্রামাণ্যচিত্রটিতে মূলত এ বিষয়গুলোই উঠে এসেছে মার্টিন স্মিথের দক্ষতায়। সাথে রয়েছে সৌদি আরবের ইতিহাস, তাঁদের ক্ষমতা কাঠামোর অনেক জটিল বিষয়।
০৪) সিক্রেট হিস্টোরি অফ আইএসআইএস
ইসলামিক স্টেট অফ ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া, সংক্ষেপে আইএসআইএস। ২০১৪ সালে যখন তারা সিরিয়া ও ইরাকের গৃহযুদ্ধের সুযোগে বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে সেখানে আবু-বকর আল বাগদাদীর নেতৃত্বে ইসলামি খেলাফতের ঘোষণা দেয়, পুরো বিশ্ব এক রকম হতবুদ্ধি হয়ে যায়। কিন্তু তাঁদের উত্থানের গল্প একদমই হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা নয়।
আবু মুসাব আল জারকাওয়ি নামে এক জর্ডানি মৌলবাদী জঙ্গি মূলত এ সংগঠনের উদ্যোক্তা। কীভাবে ইরাক যুদ্ধ থেকে আইএসআইএসের জন্ম হলো এবং কীভাবে তারা তাদের ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালায় – পুরো গল্পটা উঠে এসেছে এ প্রামাণ্যচিত্রে।
০৫) দি ক্রাউন প্রিন্স অফ সৌদি অ্যারাবিয়া
সৌদি আরবের রাজার পরে সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি ধরা হয় ক্রাউন প্রিন্সকে। রাজা সৌদের পর এখন পর্যন্ত সৌদি আরবে কোন রাজার ছেলে পরবর্তী ক্রাউন প্রিন্স হতে পারেনি। কিন্তু এক্ষেত্রে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম মোহাম্মাদ বিন সালমান, যিনি একই সাথে ক্রাউন প্রিন্স এবং রাজা সালমান ইবনে আব্দুল আজিজ আল সৌদের সন্তান। তাকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি।
প্রামাণ্যচিত্রটি মোহাম্মাদ বিন সালমানের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের উপর নির্মিত। তাঁর ভিশন ২০৩০, সৌদি আরবকে অপেক্ষাকৃত উদারপন্থী রাষ্ট্র করার চেষ্টা, কিন্তু একই সাথে অন্য যুবরাজ ও মানবাধিকার কর্মীদের সাথে তাঁর আচরণ, ইয়েমেনে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে সেখানে একটি মানবিন সংকট তৈরি করা, কাতারের উপর অবরোধ, লেবাননের সরকার উৎখাতে ব্যর্থ চেষ্টা এবং সর্বোপরি তাঁর নিকটতম মানুষদের হাতে সাংবাদিক জামাল খাসোগীর নৃশংস হত্যা ইত্যাদি উঠে এসেছে এতে।