ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি অভিযান শুরুর ছয় মাস পূর্তির এক সপ্তাহের মাথায় ফিলিস্তিন থেকে সহস্র কিলোমিটার দূরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গাজায় ইসরায়েলি অভিযানের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তা এখন পুরো যুক্তরাষ্ট্র জুড়েই ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিন গ্রেপ্তার ও বাঁধার মুখে পড়ছেন আন্দোলনকারী ছাত্র ও শিক্ষকেরা, আন্দোলনে সাবেক অনেক শিক্ষার্থীও একাত্মতা পোষণ করছেন।
কলম্বিয়া, কর্নেল, ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস অস্টিনের মত বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে তাঁবু খাটিয়ে অবস্থান নিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মুখরিত একটাই দাবিতে- “Disclose, divest, we will not stop, we will not rest”।
মোটাদাগে এটি ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি সেনাদের চালানো আগ্রাসন ও হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে আন্দোলন হিসেবে গণ্য হলেও, শিক্ষার্থীদের এমন কিছু সুনির্দিষ্ট দাবি আছে, আন্দোলনটি বুঝতে হলে যে দাবিগুলো বোঝা খুব জরুরি। এই আন্দোলন সম্পর্কে ধারণা দিতেই এই লেখা।
প্রেক্ষাপট
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের সশস্ত্র যোদ্ধাদের হাতে ইসরায়েলের সহস্রাধিক নাগরিকের মৃত্যু ও দুইশতেরও বেশি নাগরিকের জিম্মি হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজা উপত্যকায় অভিযান শুরু করে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী – আইডিএফ। ইসরায়েলের সেনা অভিযানে হামাসের যোদ্ধাদের পাশাপাশি অসংখ্য সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে শিশু নিহত হন যা নাড়া দেয় পুরো বিশ্বকে। ফলে ধীরে ধীরে পুরো বিশ্বজুড়েই আইডিএফ সেনাদের অভিযান বন্ধে আন্দোলন জোরদার হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিকে সমর্থন করে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন কিছু শিক্ষার্থী সিদ্ধান্ত নেয় ১৭ এপ্রিল তারা কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে তাঁবু খাটিয়ে অবস্থান নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে কিছু দাবি জানাবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৭ এপ্রিল কর্মসূচী পালন শুরু করার পর ১৮ এপ্রিল কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযান চালাতে পুলিশকে অনুমতি দেয়। পুলিশ শতাধিক শিক্ষার্থীকে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রেপ্তার করে, পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারও করে এই আন্দোলনে যুক্ত থাকায়।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশি অভিযানের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের ব্যাপারে আরো উজ্জীবিত হয় এবং কয়েকশত শিক্ষার্থী পুনরায় মিলিত হয়ে আন্দোলন শুরু করে। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দেখে যুক্তরাষ্ট্রের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই আন্দোলন শুরু হয়। এখন পর্যন্ত এই আন্দোলন চলছে কলম্বিয়া, কর্নেল, ইয়েল, প্রিন্সটন, সাউথ ক্যারোলাইনা, টেক্সাস অস্টিন, কলোরাডোর মত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।
ডিসক্লোজ অ্যান্ড ডাইভেস্ট
আন্দোলনকারীদের দাবি ও স্লোগান বুঝতে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আর্থিক কাঠামো বুঝতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রধান আয়ের উৎস হচ্ছে শিক্ষার্থীদের থেকে পাওয়া টিউশন ফি, সরকারি-বেসরকারি তহবিল, বিভিন্ন গবেষণা বা প্রযুক্তি বিষয়ক কাজ থেকে পাওয়া অর্থ এবং বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া বিভিন্ন অঙ্কের অনুদান ব্যবসায় লগ্নি করে পাওয়া অর্থ। এই অর্থ দিয়েই তারা তাদের দৈনন্দিন ও বার্ষিক বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা বিভাগের তথ্য অনুসারে গত দুই দশকে প্রায় ১০০টি মার্কিন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইসরায়েল বা ইসরায়েল সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে ৩৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৩০০ মিলিয়ন পাউন্ডের সমপরিমাণ অনুদান বা কাজ পাওয়ার কথা জানিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ই কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা দেশ থেকে তারা কী পরিমাণ অর্থ প্রতিবছর পেয়ে থাকে সেই সম্পর্কে জানায় না। এমনকি অনুদানের অর্থ কোথায় বিনিয়োগ করা হয়েছে তাও জানায় না।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবি, তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইসরায়েলের সাথে ব্যবসায়ীক সম্পর্ক আছে, ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে ইসরায়েলের আগ্রাসন চালানোর ফলে আর্থিকভাবে লাভবান হয় এমন প্রতিষ্ঠানগুলোতে অর্থ লগ্নি করার মাধ্যমে এবং ইসরায়েলের সরকারকে সহায়তা দেয় এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে কাজ করার মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের উপর চালানো নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞকে প্রকারান্তরে সহায়তা করছে।
তাই শিক্ষার্থীদের দাবি হচ্ছে-
- Disclose (প্রকাশ করা): বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের আর্থিক হিসাব, কোন প্রতিষ্ঠান বা দেশ থেকে কী পরিমাণ অর্থ তারা লাভ করে থাকে, এবং কোন কোন প্রতিষ্ঠানে তারা তাদের অনুদানের অর্থ বিনিয়োগ করে থাকে সেগুলো প্রকাশ করতে হবে। বিশেষ করে ইসরায়েল সংশ্লিষ্ট কোন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অনুদান পেয়েছে কিনা, এবং পেয়ে থাকলে সেটি কীভাবে ব্যয় বা বিনিয়োগ করা হচ্ছে তা জানাতে হবে শিক্ষার্থীদের। পাশাপাশি জানাতে হবে ইসরায়েলের বর্তমান অভিযানে যারা সহায়তা করছে তাদের সাথে কী ধরণের ব্যবসায়িক লেনদেন রয়েছে তা জানাতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে।
ধরা যাক, ইসরায়েল সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ‘ক’ থেকে ‘খ’ বিশ্ববিদ্যালয় ২ বিলিয়ন ডলার অনুদান পেয়েছে যা ‘গ’ প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে দেয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠান ‘গ’ ইসরায়েলে একটি জুতা তৈরির কারখানায় সেই অর্থ বিনিয়োগ করেছে। এই ক্ষেত্রে ‘খ’ বিশ্ববিদ্যালয়কে বিষয়টি সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের জানাতে হবে যেন তারা যাচাই করতে পারে যে সেই প্রতিষ্ঠানটির জুতা কারখানাটি কি ইসরায়েলের দখলে থাকা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে অবস্থিত, নাকি ১৯৪৭ সালের সীমানা অনুসারে ইসরায়েলের ভূখণ্ডে অবস্থিত। তখন শিক্ষার্থীরা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
- Divest (প্রত্যাহার করা): ইসরায়েলের জন্য অস্ত্র উৎপাদন করছে বা এমন কোন প্রযুক্তির উদ্ভাবনের সাথে জড়িত যা ইসরায়েলের চালানো সামরিক অভিযানে সহায়তা করছে এমন কোন প্রতিষ্ঠানে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন বিনিয়োগ থেকে থাকে সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে সেই বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিতে হবে। পাশাপাশি, ইসরায়েলের এই সামরিক অভিযান থেকে লাভবান হচ্ছে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনিয়োগ থাকলে তা প্রত্যাহার করে নিতে হবে।
ধরা যাক, ইসরায়েলের ড্রোনগুলো অভিযানের সময় যে প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকে, যেমন ল্যাভেন্ডার এআই, সেটি যে প্রতিষ্ঠানটি তৈরি করেছে সেখানে ‘ঘ’ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনিয়োগ আছে। যেহেতু এই প্রযুক্তি মানুষ হত্যায় জড়িত, বিশ্ববিদ্যালয়টিকে অবিলম্বে এই বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিতে হবে।
ভবিষ্যৎ
বিশেষজ্ঞদের মতে,এই আন্দোলনের চূড়ান্ত ফলাফল এখনো বোঝা সম্ভব হচ্ছে না। অতীতে ছাত্র আন্দোলনের মুখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৫০টির মত বিশ্ববিদ্যালয় জীবাশ্ম জ্বালানিতে তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে। কিন্তু এতে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি খাতে তেমন কোন প্রভাব পড়েনি। ইসরায়েলি আগ্রাসনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ কততা প্রভাব রাখছে তার সঠিক ধারণা না থাকায় বলা সম্ভব নয় যে এই আন্দোলনের ফলে যুদ্ধ কতটা বিঘ্নিত হবে।
তবে যখন পুরো বিশ্ব ইসরায়েলের এই অভিযানকে প্রতিদিনের বিষয় হিসেবে মানিয়ে নিচ্ছিল, তখন মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে এই রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে ফিলিস্তিনের দিকে মনোযোগ নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে এই আন্দোলন।
সূত্র- স্কাই নিউজ, দি নিউ ইয়র্ক টাইমস এবং আন্দোলনকারীদের সাক্ষাৎকার।
লেখাটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন জারিন আশরাফ মুন।