আপনাকে যদি বলা হয় বাংলাদেশি জাতীয়তা নিয়ে কেউ ফ্রেঞ্চ সেনাবাহিনীতে চাকরি করছে, তাও যেনতেন নিয়মিত সেনাসদস্য হিসেবে নয়, রীতিমতো স্পেশাল এলিট ফোর্সের অংশ হয়ে, আপনি হয়তো বিশ্বাস করবেন না বা অসম্ভব বলে উড়িয়ে দেবেন। অনেকটা বিস্ময়কর হলেও সত্য যে এ মূহুর্তে ফ্রেঞ্চ সেনাবাহিনীতে কাজ করছেন কিছু বাংলাদেশি। আরেকটু খোলাশা করেই বলি কীভাবে এই বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছে। ফ্রেঞ্চ ফরেন লিজিওন ও এক বাংলাদেশির গল্প বলবো আজ।
কিছুটা অদ্ভুত এ ব্যাপারটা। বিশ্বের হাতেগোনা কয়েকটি দেশ আছে যারা তাদের জাতীয় নিরাপত্তারক্ষী বাহিনীতে ভিনদেশী জাতীয়তার মানুষ নিয়ে থাকে। যেমন, পাশের দেশ ভারতের জাতীয় বাহিনীতে নেপাল, ভূটানি, এমনকি তিব্বত থেকে ভারতে নির্বাসনে আসা সাধারণ জনগণকেও কাজ করার সুযোগ দেয়া হয়। নেপালি গোর্খারা যেমন গত ২০০ বছর জুড়ে ব্রিটিশ রাজকীয় বাহিনীতে গোর্খা রেজিমেন্টে সুনামের সাথে কাজ করে যাচ্ছে, তেমনি তারা কাজ করছে সিঙ্গাপুর আর ব্রুনাইয়ের সেনাবাহিনীতেও। দক্ষিণ আমেরিকার ল্যাটিন দেশগুলো বা প্রাক্তন স্প্যানিশ কলোনিগুলোর নাগরিকদেরও সু্যোগ রয়েছে স্পেনের জাতীয় বাহিনীর এলিট ফোর্স স্প্যানিশ লিজিওনে যোগদান করার। কিন্তু বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের নেয়ার ক্ষেত্রে সম্ভবত সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হলো ফ্রেঞ্চ ফরেন লিজিওন। “লিজিওন এত্রাঞ্জে” হলো এর ফরাসি নাম। এটি যাত্রা শুরু করেছিলো ১৮৩১ সালে।
ফ্রেঞ্চ ফরেন লিজিওনে গত তিন বছর ধরে সুনামের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন আশরাফুল আদম নামে এক বাংলাদেশি। ২০০৯ সালে তিনি লন্ডনে আসেন কম্পিউটার সায়েন্সে উচ্চতর শিক্ষায়। কিন্তু ব্রিটেনের ব্যয়সাপেক্ষ পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। তিনি এটাও বুঝতে পারেন যে একঘেয়েমি জীবন তাঁর জন্য নয়। বরং সেনাবাহিনীর রোমাঞ্চকর জীবন তাঁকে সবসময় আকৃষ্ট করেছে। ঠিক করলেন দেশে ফিরে আর্মিতে যোগ দেবার চেষ্টা করবেন। সাথে জানার চেষ্টা করলেন কমনওয়েলথ কোটায় ব্রিটিশ আর্মিতে কাজ করা যায় কিনা। তখনই খোঁজ পান ফ্রেঞ্চ ফরেন লিজিওনের। একদিন আশরাফুল চলে গেলেন ফ্রেঞ্চ দূতাবাসে ভিসার জন্য। তারা তাঁকে প্রথমে জিজ্ঞাসা করলেন তাঁর ফ্রান্সে যেতে চাওয়ার কারণ। সাহস নিয়ে আশরাফুল বলেই ফেললেন যে তিনি লিজিওনে যোগদান করতে চান। তাঁর অকপট উত্তরে বিস্মিত হয়েছিলেন দূতাবাসের কর্মকর্তারা। লিজিওনে যোগদান করার জন্য বাংলাদেশিদের ভিসা চাইতে আসার ঘটনা বিরল। তারা আশরাফুলকে উৎসাহিত করলেন। কিছুদিনের মধ্যেই ভিসাও হয়ে গেলো। প্যারিসে পৌঁছে আশরাফুল চলে গেলেন লিজিওনের রিক্রুটমেন্ট সেন্টারে।
লিজিওনে যোগ দিতে হলে ফ্রেঞ্চ ভাষা জানা বাধ্যতামূলক না। শুরুতে পাসপোর্ট দেখে ছোটখাটো একটা ফিটনেস পরীক্ষা নেয়া হয়। এক্ষেত্রে সাইকোলজিক্যাল টেস্টের পাশাপাশি ফিজিক্যাল টেস্ট (পুল আপস, বিপ টেস্ট, আর কুপার টেস্ট) থাকে। আশারাফুল প্রথম ধাপে টিকতে পারেননি। তাঁর ফিটনেস লিজিওনে যোগদানের উপযুক্ত ছিলো না। তাই রিক্রুটমেন্ট কেন্দ্র থেকে তাঁকে বলা হয় ন্যূনতম শারীরিক যোগ্যতা নিয়ে তিন মাস পর আবার আসার জন্য। তিন মাসের অধ্যবসায় বৃথা যায় নি। আশরাফুলকে পাঠিয়ে দেয়া হয় চার মাসের বেসিক লিজিওনার ট্রেনিংয়ের জন্য।
প্রতিটা ব্যাচে ৪৫ জন কষ্টসাধ্য ট্রেনিং শুরু করলেও শেষ করতে পারেন মাত্র ২০-২৫ জন। আশরাফুলের শুরুটাও এমনি ছিলো। ৬ দফা মৌখিক পরীক্ষা আর ৬ দফা শারীরিক পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছিলো তাঁকে। তারপর চার মাসের বেসিক ট্রেনিং পেরিয়ে সাইন করলেন ন্যূনতম ৫ বছরের কাজ করার কন্ট্রাক্ট। সাথে অর্জন করলেন লিজিওনের প্রতীক গ্রিন বেরেট। এরপর যোগ দেন ফার্স্ট ফরেন ইঞ্জিনিয়ারিং রেজিমেন্টে স্যাপার হিসেবে। ইতোমধ্যে ২০১৩ সালে মালিতে লিজিওনের হয়ে অপারেশন সারভাল (Operation Serval) মিশনে অংশগ্রহণ করেছেন।
ব্যক্তি আশরাফুল ভাইয়ের কথা
আশরাফুল ভাইয়ের সাথে তাঁর রোমাঞ্চকর জীবন, ক্যারিয়ার আর ভবিষ্যত নিয়ে কথা হচ্ছিলো প্যারিসের গার দ্য নর্দের রেজা ভাইয়ের দোকানে। কথা প্রসঙ্গে আরেকটা ব্যাপার জানা গেলো। তাঁর জানা মতে আরো দুইজন বাংলাদেশি লিজিওনে কাজ করছেন। তিনি সবসময় তাঁর অন্য রেজিমেন্টের সহকর্মীদের বলে রাখেন যে কোন বাংলাদেশি থেকে থাকলে তাঁকে যেন জানানো হয়।
ভবিষ্যতে বিস্ফোরক বা আই ই ডি (IED: Improvised Explosive Device) স্পেশালিস্ট হিসেবে নিজেকে দেখতে চান আশরাফুল ভাই। লিজিওনে বাংলাদেশি হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে অত্যন্ত গর্ব বোধ করেন তিনি। সবসময় নিজেকে শারীরিকভাবে সক্ষম রাখতে চান। তাঁর ফেসবুকে এক ভিডিওতে দেখছিলাম টানা ২৫টা পুল-আপ দিতে। লিজিওনে ১২ মিনিটে কমপক্ষে ২৮০০ মিটার রানিং করতে হয়। এর নিচে হলে বাদ দিয়ে দেয়া হয়। আশরাফুল ভাই ১২ মিনিটে যেতে পারেন ৩২০০ মিটার। তাঁর ভাষ্যমতে, লিজিওনে সবসময় আপনাকে ফিটনেস বজায় রাখতে হয়। কারণ? যেকোন সময় যেকোন মিশনে যাবার ডাক আসতে পারে।
এক রাশিয়ান সহকর্মীকে বাংলায় শুভ সকাল ও ধন্যবাদ শিখিয়েছেন আশরাফুল ভাই। দেশ থেকে রসগোল্লা, নিমকি, তিলের নাড়ু, বুটের হালুয়া, ফুল পিঠা, চালতার আচার আর আস্ত কাঁঠাল নিয়ে এসেছিলেন একবার! তাঁর সহকর্মীদের মাথা খারাপ হবার জোগাড় আমাদের সংস্কৃতি ও খাবারের ঐতিহ্য দেখে। এক ছবিতে দেখলাম তাঁর রুমে বড় এক বাংলাদেশের পতাকা আর তার সামনে লিজিওনের অফিশিয়াল পোশাকে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন।
আশরাফুল ভাইয়ের কথা শুনে, তাঁকে দেখে ভাবছিলাম “কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে” বাংলাদেশি সূর্যসন্তান এখনো অনেক আছে। তাঁদের বেশিরভাগের কথাই হয়তো শোনা হয়নি আমাদের। আনসাং হিরোদের মত তাঁরা দেশের নাম আগলে ধরে সসম্মানে নিজের ও দেশের নাম উজ্জ্বল করে যাচ্ছেন বিশ্বের নানা প্রান্তরে। আমাদের গর্ব তো তাঁরাই!
ফ্রেঞ্চ ফরেন লিজিওন: সংযোজন
ছবি ১. ফ্রান্সে ‘ক্যাম্প লেহনিনে’ আর্বান জোন কম্বেট ট্রেনিংয়ে আশরাফুল আদম।
১. প্রাথমিক টেস্টে পুল আপ্স – লেখা আছে ৪টা দেয়া লাগে। কিন্ত ৮/১০ টার নিচে হলে নেয় না। কুপার টেস্ট- ২৮০০ মিটার, বিপ টেস্ট (২০ মিটারের শাফল রানিং) – ৮ ধাপ।
২. লিজিওনের প্রতীক হলো সাদা কেপি (এক প্রকার ফ্রেঞ্চ টুপি)। কেপি পাওয়ার আগে হলো রিক্রুট, পরে লিজিওনিয়ার। ১ মাস বেসিক ট্রেনিংয়ের পর একটা মার্চ হয় ৫৫/৬০ কিলোমিটারের। এতে ২৫ কেজির মতো ওজন বহন করতে হয়। যারা এ মার্চ শেষ করতে পারে, তাদেরকে সাদা কেপি দেয়া হয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। সাদা কেপি পাবার মাধ্যমে তারা পরিচিত হন লিজিওনিয়ার হিসাবে। বাকিরা বাদ পড়ে যায়।
৩. লিজিওনের মটো- “লিজিওন পাত্রিয়া নসট্রা” (The Legion is our Fatherland)। আরেকটা হলো “Marche ou crève” বা “March or Die”।
৪. বিস্তারিত জানতে চান? লিজিওনের ওয়েবসাইটে যেতে পারেন।