ইরাকের আলোচিত-সমালোচিত রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হোসেন একসময় মধ্যপ্রাচ্যের যে কোন সংকটে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিলেন। এক সময় পশ্চিমাদের মিত্র হিসেবে গণ্য হওয়া সাদ্দামের পতন হয় ইরাকে ইঙ্গ-মার্কিন অভিযানের মধ্য দিয়ে যা বদলে দেয় পুরো মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি। মধ্যপ্রাচ্য ও ফিলিস্তিন সংকট বুঝতে সাদ্দাম হোসেন ও ইরাক সম্পর্কেও বোঝা জরুরি। তাই কুইজার্ডসের এই আয়োজন সাদ্দাম হোসেন ও ইরাক নিয়ে।
ইরাক-ইরান যুদ্ধ
পশ্চিমাদের কাছে ইরাকের স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেনের গুরুত্ব বাড়ে মূলত ১৯৭৯ সালের ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পরে। সাদ্দাম হোসেন ছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের সমাজতান্ত্রিক দল বা’থ পার্টির নেতা যেই সংগঠনটি আদর্শিক কারণে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বভাবজাত মিত্র ছিল মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে মার্কিন অনুগত মোহাম্মাদ রেজা পাহলভীর ইরান এবং সৌদি আরবের ঠিক মাঝখানে তাদের ভৌগলিক অবস্থানের কারণে।
কিন্তু ১৯৭৯ সালে ইরানের বিপ্লবে পশ্চিমা নীতি বিরোধী আয়াতুল্লাহ খোমেনির উত্থান এবং এরপর যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের কর্মকর্তাদের ইরানি তরুণ-তরুণীদের হাতে জিম্মি হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বদলে যেতে শুরু করে হিসাব-নিকাশ।
ধর্মনিরপেক্ষ বা’থ পার্টির নেতা হলেও সাদ্দাম হোসেন ছিলেন সুন্নি সম্প্রদায়ের এবং তিনি তার সরকারকে সাজিয়েছিলেন নিজের সম্প্রদায়ের ব্যক্তিদের দিয়েই, যদিও ইরাকের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শিয়া সম্প্রদায়ের মুসলিম। শিয়া মুসলিম অধ্যুষিত ইরান যখন মধ্যপ্রাচ্যে “বিপ্লব রপ্তানি” তত্ত্ব (Exporting Revolution) সামনে আনে, স্বৈরশাসক সাদ্দাম ও তার অনুসারীরা তখন প্রমাদ গুনতে থাকেন।
এদিকে ইরানে বিপ্লব পরবর্তী সময়ে শাহ ও মার্কিনিদের অনুগত সেনা কর্মকর্তাদেরকে বিচারের আওতায় আনা হয়, অনেকে মৃত্যুদণ্ডও পান। তাই সাদ্দামের ধারণা ছিল ইরানকে অপ্রস্তুত অবস্থায় হামলা করলে ইরানের নতুন সরকারের পতন ঘটবে। অন্যদিকে সৌদি আরবের তেলসমৃদ্ধ ও শিয়া অধ্যুষিত পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে ১৯৭৯ সালে ঘটে যাওয়া এক ব্যর্থ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সৌদি আরব ও পশ্চিমা মিত্ররাও ইরানের শিয়া প্রধান সরকারকে উৎখাতে যেকোন পদক্ষেপকে সমর্থন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
এই হিসাব-নিকাশের প্রেক্ষিতে ১৯৮০ সালে সাদ্দাম হোসেন হামলা চালায় ইরানে। প্রথম দিকে দ্রুত কিছু সাফল্য আসলেও ইরানের আধ্যাত্মিক নেতা খোমেনির নির্দেশে যখন দলে দলে ইরানিরা সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে হিউম্যান ওয়েভ কৌশল ইরাকের বিরুদ্ধে ব্যবহার শুরু করে তখন ইরাকি সেনাবাহিনী পিছু হটতে শুরু করে এবং এক পর্যায়ে উলটো ইরানের বাহিনী ইরাকে ঢুকে পড়ে। এভাবে প্রায় ৮ বছর দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ চলে, এবং ১৯৮৮ সালে আন্তর্জাতিক সীমানারেখা মেনে শেষ হয় যুদ্ধের।
কুয়েত আগ্রাসন
ইরানের সাথে আট বছরের যুদ্ধে ইরাকের অর্থনৈতিক দুর্দশা চরমে পৌঁছে। এছাড়াও বিভিন্ন দেশের কাছে ইরাক বিপুল পরিমাণে ঋণও করে যুদ্ধের কারণে, যার মধ্যে কুয়েত থেকে পাওয়া ঋণ ছিল প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ তেল রপ্তানিকারী দেশ হিসেবে সাদ্দামের ইরাক যুদ্ধ শেষে আগের চেয়ে বেশি তেল রপ্তানি করে পেট্রো ডলার আয় করে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে চাচ্ছিল।
কিন্তু তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ওপেকে দাম না বাড়ানোর ব্যাপারে কুয়েতের অবস্থান ক্ষিপ্ত করে ইরাককে। এছাড়া ইরাকের ঋণ মওকুফ করে দেয়ার অনুরোধেও সাড়া দেয়নি কুয়েত।
এমন অবস্থায় ইরাক-কুয়েতের সীমান্তবর্তী রুমাইলা তেলের খনি থেকে গোপনে কুয়েত ইরাকের অংশের তেল চুরি করছে এমন অভিযোগ তুলে ১৯৯০ সালে সাদ্দাম হোসেন কুয়েত দখলের নির্দেশ দেন। কুয়েতে আগ্রাসন চালানোর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা তুললে তিনি জানান যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক ও কুয়েতের দ্বন্দ্বের বিষয়ে কোন অবস্থান নেই। সাদ্দাম সরকার এটিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবুজ সংকেত হিসেবে মনে করেছিল।
ইরাকের কুয়েত আগ্রাসন সাদ্দামের জন্য হিতে বিপরীত হয়। কুয়েত দখলের পর সেখানে ইরাকি সেনাদের বর্বরতার খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উঠে আসতে শুরু করলে গালফ, তথা আরব উপসাগরীয় অঞ্চলে সেনা অভিযানের সিদ্ধান্ত নেয় যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্ররা। মিত্রদের তালিকায় বাংলাদেশের সেনাবাহিনীও ছিল।
যৌথ বাহিনীর আক্রমণে ইরাকের সেনাবাহিনীর যানবাহন ও সমরাস্ত্রের একটা বড় অংশ রীতিমত নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। কুয়েত থেকে যেই পথে তারা পালাচ্ছিল সেই রাস্তায় পলায়নপর ইরাকি সেনাদের সমরযান, ট্যাঙ্ক, আর্মার্ড ভেহিকল ইত্যাদি মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হয় জঙ্গিবিমান দিয়ে। ইরাক ও কুয়েতের মধ্যকার এই মহাসড়কটি হাইওয়ে অফ ডেথ নামে পরিচিত।
ইরাকের সেনাবাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় হয় এই যুদ্ধে। জাতিসংঘ ও পশ্চিমাদের বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা আসে এবং কুয়েত ও মিত্র দেশগুলোকে যুদ্ধের জন্য ক্ষতিপূরণ দিতেও রাজি হয় ইরাক।
বাফার স্টেট
সাদ্দাম হোসেন ছিলেন ভয়াবহ অত্যাচারী স্বৈরশাসক। তিনি তার নিজের দুই মেয়ের স্বামী যারা তার ছেলের ভয়ে জর্ডান পালিয়ে গিয়েছিল, তাদেরকে ক্ষমা করে দেশে ফিরিয়ে এনে হত্যা করেন।
বা’থ পার্টির মধ্যে তার বিরোধীদেরকে শায়েস্তা করার জন্য মুহি আব্দুল-হোসেন মাশহাদি নামে দলের শীর্ষ এক নেতাকে জিম্মি করে তার উপর নির্যাতন চালিয়ে তাকে বলতে বাধ্য করা হয় যে তিনি এবং বা’থ পার্টির পঞ্চাশ জনেরও বেশি শীর্ষ পর্যায়ের নেতা মিলে সাদ্দামকে ক্ষমতাচ্যূত করার ষড়যন্ত্র করেছেন। সংগঠনটির একটি সমাবেশে একে একে নির্যাতিত সেই নেতা প্রাণভয়ে পড়ে শোনান দলের সাদ্দাম বিরোধী নেতাদের নাম যারা সেই কথিত ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিল। তাদের অনেককেই হত্যা করা হয়।
কুর্দি এবং শিয়া সম্প্রদায়ের উপর তার নির্যাতন ও হামলা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে ১৯৯১ সালে ইরাকে নো-ফ্লাই জোন ঘোষনা করা হয়েছিল যা ইরাকে ইঙ্গ-মার্কিন হামলা শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত বহাল ছিল। বহু কুর্দি ও শিয়া পরিবার সাদ্দাম হোসেনের বাহিনীর হাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল।
এছাড়া ইরাক উপসাগরীয় যুদ্ধে পরাজিত হয়ে যে ক্ষতিপূরণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেই প্রতিশ্রুতিও রক্ষা করেনি।
এত কিছুর পরেও সাদ্দাম ও ইরাকের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন কোন বড় ধরণের ব্যবস্থা না নেয়ার অন্যতম কারণ ছিল শিয়া অধ্যুষিত ইরান ও সুন্নি অধ্যুষিত তেল সমৃদ্ধ সৌদি আরবের মাঝখানে ইরাক ছিল একটা বাফার স্টেট যা সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে কোন সরাসরি সংকট ঠেকাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারতো। এমনকি ২০০৩ সালের ইঙ্গ-মার্কিন হামলা শুরুর আগেও আরব দেশগুলো এই হামলার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল।
পতন
২০০৩ সালে ইরাকে ভয়ংকর মারণাস্ত্র রয়েছে এবং ইরাক তা সবার থেকে লুকিয়ে রেখেছে দাবি করে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ইরাকে হামলা চালায়। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সাদ্দাম হোসেন পালিয়ে যান। তার দুই ছেলে, যারা অকথ্য নির্যাতনে পারদর্শী হিসেবে কুখ্যাত ছিলেন তারা যৌথ বাহিনীর হামলায় মারা যান। প্রায় ছয় মাস খোঁজাখুঁজির পর সাদ্দামকে তার জন্মভূমি তিকরিতের কাছেই আদ-দ্বার নামে একটি জায়গায় মাটির নীচে বাঙ্কারে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় গ্রেপ্তার করা হয়, সেই বছর ডিসেম্বরে, এবং বিচার শুরু করা হয়।
বিচারে তার মৃত্যুদণ্ডের রায় হলে ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে ঈদ-উল-আজহার প্রথম দিন তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তার মৃত্যুর সময় পেছনে কিছু ব্যক্তিকে “মুকতাদা, মুকতাদা” স্লোগান দিতে শোনা যায়। ধারণা করা হয় তারা শিয়া নেতা মুকতাদা আল-সদরের অনুসারী ছিলেন, যার বাবা এবং দুই ভাইকে সাদ্দামের সমর্থকেরা হত্যা করেছিল ১৯৯৯ সালে।