বিশ্ব জুড়ে সম্প্রতি ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছে হাজারে হাজারে মানুষ। তাঁদের চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন চিকিৎসকেরাও। এবং দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, অনেক চিকিৎসক মারাও গেছেন। এ চিকিৎসকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক চিকিৎসক ছিলেন অভিবাসী। তাঁদের নিয়ে আমাদের এ আয়োজন।
আমজেদ এল-হাওরানী: পিতৃতুল্য চিকিৎসক
সুদানে জন্মগ্রহণকারী আমজেদ ছিলেন ছয় ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয়। ব্যক্তিগত জীবনে নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ হিসেবে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালে সেবা দান করে আসছিলেন। কোন পূর্ববতী শারীরিক সমস্যা না থাকা সত্ত্বেও আমগেদ ৫৫ বছর বয়সে শনিবারে একটি হাসপাতালে মারা যান।
তাঁর ছোট ভাই আমালের ভাষ্যমতে, তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ একজন ব্যক্তি। তিনি আরো বলেন, “মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রচণ্ড শক্তিশালী ছিলেন আমগেদ, কিন্তু এ শক্তির প্রকাশ তিনি শান্ত ও নম্রভাবে করতেন। এ শক্তিটাই তিনি ব্যয় করেছেন একজন রক্ষাকারী, মানুষের জন্য ও তাঁর ভাইদের পক্ষে লড়াই করার জন্যে; এবং আরো নানা জায়গায় ভালো কাজের জন্যে।”
আব্দুল মাবুদ চৌধুরী: বাঙালি তরুণদের আদর্শ
বাংলাদেশ থেকে প্রায় দুই যুগ আগে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমানো আব্দুল মাবুদ চৌধুরী ছিলেন এক ইউরোলোজিস্ট। স্থানীয় বাংলাদেশি তরুণদের কাছে তিনি ছিলেন একজন আদর্শ মানুষ যাকে অনেকেই অনুসরণ করতেন। স্থানীয় বাংলাদেশিদের অনুপ্রেরণাও যোগাতেন তিনি।
করোনাভাইরাস সংকট শুরু হলে তিনি মার্চের ১৮ তারিখ একটি ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে চিকিৎসকদের করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের (Personal Protective Equipment) অপ্রতুলতা উল্লেখ করে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে যথেষ্ট পরিমাণে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম নিশ্চিতের আহ্বান জানান।
গত ৯ এপ্রিল, ১৫ দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিলো ৫৩ বছর।
হাবিব জায়েদী: একজন নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক
পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত হাবিব জায়েদী প্রায় ৫০ বছর আগে যুক্তরাজ্যে চলে এসে দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডের এসেক্সে লে-অন-সি-তে কাজ করেছিলেন। বুধবার, ৭৬ বছর বয়সে, তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ১ সপ্তাহ ধরে সেলফ-আইসোলেশনে থাকা হাবিবকে হাসপাতালে নেয়ার ২৪ ঘন্টার মধ্যে তাঁর মৃত্যু হয়।
তাঁর মেয়ে ড. সারা জায়েদী বলেন, তাঁর মৃত্যু তাঁর আত্মত্যাগের প্রতিফলন এবং সেবার প্রতি তাঁর নিবেদিত মনোভাবের এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
আদিল এল তায়ার: সদা আশাবাদী মানুষ
ডাঃ এল তায়ার ১৯৮২ সালে খার্তুম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের পরামর্শক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এল-তায়ার ১৯৯৬ সালে যুক্তরাজ্যে চলে যান। সেখানে তিনি পশ্চিম লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। ২০০৭ সালে সৌদি আরব যাওয়ার আগে টুটিংয়ের সেন্ট জর্জ হাসপাতালে ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্জন হিসাবে কাজ করেছিলেন। কাজ করেছেন সৌদি আরবের জেদ্দার কিং ফাহাদ জেনারেল হাসপাতালে তিন বছর।
করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে জরুরি বিভাগের স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে ইংল্যান্ডের পশ্চিমে হেরফোর্ড কাউন্টি হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন আদিল। তাঁর পরিবারের বিশ্বাস, সেখানে তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। করোনাভাইরাসের লক্ষণগুলি দেখা দেয়া শুরু করলে তিনি নিজেকে সেলফ-আইসোলেশনে নিয়ে যান। হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর শীঘ্রই তাকে একটি ভেন্টিলেটর দেওয়া হয়েছিলো। সেখানেই তিনি মারা যান।
আদিল একজন আশাবাদী মানুষ ছিলেন। তিনি কখনো চরম অবস্থার কল্পনাও করতে পারেননি। বরং ভেবেছিলেন যে, তিনি শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠবেন। তবে এক সপ্তাহ পর তাঁর অবস্থা আরো খারাপ হয়। দেখা দিয়েছিলো খুব শ্বাস-প্রশ্বাসের বড় সমস্যা।
আলফা সা’আদু: একজন কিংবদন্তিতুল্য চিকিৎসক
নাইজেরিয়ায় জন্মগ্রহণকারী আলফা সা’আদু প্রায় ৪০ বছর ধরে যুক্তরাজ্যের সরকারি উদ্যোগে পরিচালিত স্বাস্থ্যসেবা ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের সাথে কাজ করেছিলেন। মঙ্গলবার ভাইরাসের সাথে দুই সপ্তাহ লড়াইয়ের পর ৬৮ বছর বয়সে মারা যান তিনি। নাইজেরিয়ায় জন্মগ্রহণকারী, সাদু লন্ডনে এসে ১৯৭৬ সালে ইউনিভার্সিটি কলেজ হাসপাতাল মেডিকেল স্কুল থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের সময় জেরিয়াট্রিক ওষুধের পরামর্শদাতা চিকিৎসক হিসাবে চিকিৎসয়া জীবন শুরু করেছিলেন।
২০১৭ সালে অবসর গ্রহণের পরেও ডাঃ সা’আদু হার্টফোর্ডশায়ারের ওয়েলউইনের কুইন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হাসপাতালে খণ্ডকালীন কাজ চালিয়ে গেছেন। ডাঃ সা’আদু সরকারের পরামর্শকে গুরুত্ব সহকারে নেবার জন্য জনগণকে সতর্ক করেছিলেন। তাঁর ছেলে দানি সা’আদু বলেন, “তিনি খুব আবেগপ্রবণ মানুষ ছিলেন, তিনি মানুষকে বাঁচানোর বিষয়ে চিন্তা করতেন।”