টেংকু আব্দুর রহমানকে মালয়েশিয়ার জাতির পিতার স্বীকৃতি দেয়া হলেও আজ মালয়েশিয়ার দেশ হিসেবে এ অবস্থানে আসার পেছনে যে মানুষটাকে সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব দেয়া হয়, তিনি মাহাথির বিন মোহাম্মদ।
মালয়েশিয়া মূলত তিনটি প্রধান জাতির আবাসস্থল – স্থানীয় মালয় জাতি, অভিবাসী চীনা ও অভিবাসী ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষ। সাথে আছে আদিবাসী জনগোষ্ঠী। স্বাধীনতা লাভের পর মালয়েশিয়ার সরকার প্রধানদের সামনে একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, সবাইকে নিয়ে একসাথে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে মালয়েশিয়াকে উচ্চ-মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করার কৃতিত্ব অবশ্যই মাহাথির মোহাম্মদ, তাঁর দল এবং জোটের।
১৯৮১ সালে বারিসান ন্যাসনাল জোটের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী হন মাহাথির বিন মোহাম্মদ। টানা পাঁচ নির্বাচনে জিতে প্রায় ২২ বছর ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। তবে এ ২২ বছরে মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে এমন কিছু ঘটনার জন্ম নেয় যার রেশ রয়ে গেছে এখনো।
মাহাথির-আনোয়ার দ্বন্দ্ব
আনোয়ার ইবরাহিম ছিলেন মাহাথিরের রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের (ইউএনএমও) শীর্ষ নেতাদের একজন। মাহাথির মোহাম্মদ যখন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী, আনোয়ার ইবরাহিম তখন বিভিন্ন মেয়াদে শিক্ষা, কৃষি এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। মাহাথিরের সম্ভাব্য রাজনৈতিক উত্তরসূরিদের একজন হিসেবে ধরা হতো তাঁকে। ১৯৯৩ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন মালয়েশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী। ১৯৯৮ সালে আমেরিকার নিউজউইক ম্যাগাজিন আনোয়ার ইবরাহিমকে “এশিয়ান অফ দ্য ইয়ার” ঘোষণা করে।
কিন্তু নব্বইর দশকের শেষভাগে আনোয়ার ইবরাহিমের সাথে তাঁদের তৎকালীন রাজনৈতিক দল ইউএনএমওর ভেতরে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি এবং সরকারের বেশ কিছু নীতির বাস্তবায়ন নিয়ে মাহাথির মোহাম্মদের দূরত্ব তৈরি হয়। হঠাৎ করেই আনোয়ার ইবরাহিমবিরোধী প্রচারণা শুরু হয় দলের ভেতরে-বাইরে। তাঁর বিরুদ্ধে সমকামের অভিযোগও আনা হয়। দল থেকে বহিষ্কার করা হয় তাঁকে। ১৯৯৮ সালে তাঁকে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। তৎকালীন পুলিশের আইজিপি রহিম নূর নিজে তাঁকে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন করেন।
মাহাথির পরবর্তী মালয়েশিয়ার রাজনীতি
আনোয়ার ইবরাহিমের বিদায়ের পর মাহাথিরের উত্তরসূরী হিসেবে সামনে আসেন আবদুল্লাহ আহমদ বাদাওয়ি। ২০০৩ সালে মাহাথির মোহাম্মদের রাজনৈতিক অবসরের পর প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। উদারপন্থী হিসেবে পরিচিত বাদাওয়ির অর্থনৈতিক মন্দার মুখে দেশ চালাতে হিমশিম খান। ছয় বছরের মাথায় ২০০৯ সালে দুর্নীতি ঠেকাতে অক্ষমতা ও বিচার বিভাগ সংস্কারে ব্যর্থতার দায় মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করেন তিনি।
আবদুল্লাহ বাদাওয়ির বিদায়ের পর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন নাজিব রাজ্জাক। ক্ষমতায় এসেই নাজিব রাজ্জাক বিভিন্ন উচ্চাভিলাষী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন যার অন্যতম ছিল 1MDB, ওয়ান মালয়েশিয়ান ডেভলপমেন্ট বেরহাদ। ২০১৫ সালে দ্য ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে টাকা পাচার ও আত্মসাৎ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করলে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক অঙ্গন।
এদিকে নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলোকে আদালতের মাধ্যমে মিথ্যা প্রমাণ করে ২০০৮ সালে মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে পুনরায় প্রবেশ করেন সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইবরাহিম। তাঁর অনুসারীরা তিনি জেলে থাকতেই তাঁর চিকিৎসক স্ত্রীর নেতৃত্বে নতুন দল পিপলস জাস্টিস পার্টি (পিকেআর) গঠন করেন। বারিসান ন্যাসনালের দুই প্রধানমন্ত্রী আবদুল্লাহ বাদাওয়ি এবং নাজিব রাজ্জাকের সরকারের দুর্নীতি ও সরকার পরিচালনায় ব্যর্থতা আনোয়ারের ইবরাহিমের দলকে ইউএনএমওর নেতৃত্বাধীন বারিসান ন্যাসনাল জোটের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার ভিত্তি তৈরি করে দেয়। মালয়েশিয়ার স্বাধীনতার পর থেকে ইউএনএমও ও বারিসান ন্যাসনাল কখনো ক্ষমতাচ্যুত হয়নি।
নাজিব রাজ্জাকের বিরুদ্ধে ওঠা ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ মালয়েশিয়ার প্রবাদপ্রতিম নেতা মাহাথির মোহাম্মদকেও রাজনীতিতে নিয়ে আসে। ২০১৬ সালে তিনি গঠন করেন মালয়েশিয়ান ইউনাইটেড ইন্ডিজেনাস পার্টি (পিপিবিএম)। লড়াইয়ে নামার ঘোষণা দেন নিজ দল ও জোটের বিরুদ্ধেই।
সম্ভাবনার জোট
আনোয়ার ইবরাহিমের নেতৃত্বে ২০১৫ সালে গঠিত হয় নতুন জোট পাকাতান হারাপান, যার বাংলা অর্থ সম্ভবনার জোট। এদিকে মাহাথির মোহাম্মদ নতুন দল গঠনের পর যোগ দেন আনোয়ার ইবরাহিমের দলের নেতৃত্বাধীন জোটে। তাঁকে সামনে রেখেই ২০১৮ সালে নির্বাচনী লড়াইয়ে নামে পাকাতান হারাপান। ইউএনএমও নেতা ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজ্জাকের নেতৃত্বাধীন প্রতিপক্ষ বারিসান ন্যাসনালের বিরুদ্ধে নির্বাচনে জয়ীও হয় এ নতুন জোট। প্রথমবারের মতো মালয়েশিয়ার ক্ষমতা হাতছাড়া হয় ইউএনএমও ও বারিসান ন্যাসনালের।
নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেন মাহাথির মোহাম্মদ। উপ-প্রধানমন্ত্রী হন আনোয়ার ইবরাহিমের স্ত্রী ওয়ান আজিজা ওয়ান ইসমাইল। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে পিকেআরের আজমিন আলী অর্থ এবং পিপিবিএমের মুহিউদ্দীন ইয়াসিন পান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ২০১৯ সালে আল-জাজিরার সাথে একটি সাক্ষাৎকারে এক প্রশ্নের জবাবে মালয়েশিয়ার পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আনোয়ার ইবরাহিমের নাম বলেন।
সময়সীমা ও সংকট
২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়ের পর ঠিক কতদিন মাহাথির প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন এবং কবে নাগাদ আনোয়ার ইবরাহিমের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন, তার কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা দেননি। একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা দেয়া নিয়ে মাহাথির ও আনোয়ারের মধ্যে অস্বস্তি ছিল। ২০১৯ সালের শেষভাগ থেকে আনোয়ারের দলের পক্ষ থেকে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার জন্য মাহাথিরের উপর চাপ প্রয়োগ করা হতে থাকে বলে জানা যায়।
এ অবস্থায় ২০১৯ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৫টি উপ-নির্বাচনে বারিসানের প্রার্থীরা ভালো করে। এতে জোটের নেতৃত্বদানকারী দল ইউএমএনও রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনায় আসে।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে অর্থমন্ত্রী আজমিন আলীর নেতৃত্বে পিকেআরের একটি অংশ এবং মাহাথিরের দল পিপিবিএমের মুহিউদ্দীন ইয়াসিনের নেতৃত্বে দলটির বড় অংশ ইউএনএমও ও বারিসান জোটের অন্যান্য দলের সাথে একটি সরকার গঠনের ব্যাপারে আলোচনা শুরু করে, যা পাকাতান হারাপান জোটে অস্বস্তি সৃষ্টি করে।
অন্যদিকে ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে পাকাতান হারাপান জোট একটি বৈঠকে বসলে সেখানেও মাহাথির মোহাম্মদ ক্ষমতা হস্তান্তরের কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা দেননি। ফলে জোটের মধ্যে পুরনো অস্বস্তিও রয়ে যায়। এ অবস্থায় ২৪ ফেব্রুয়ারি মাহাথির মোহাম্মদ প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন। তাঁর দলও জোট থেকে বের হয়ে যায়।
মাহাথিরের দলের জোট থেকে বেরিয়ে ইউএনএমওর সাথে সখ্যতা, আনোয়ারের দল থেকে একটা অংশের বের হয়ে এসে বারিসান জোটের ঘনিষ্ঠ হওয়া এবং মাহাথিরের পক্ষ থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরে কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা না দেয়া – এই তিনটি প্রভাবক কাজ করেছে মাহাথিরের পদত্যাগের পেছনে।
সংকট শেষ নাকি শুরু?
এ তিনটি কারণের প্রধান কারণ হিসেবে ধারণা করা হচ্ছে মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে আনোয়ার ইবরাহিমের প্রতি অবিশ্বাস ও গ্রহণযোগ্যতার অভাব। মূলত এক সময়ের রাজনৈতিক শত্রু আনোয়ার ইবরাহিমের প্রধানমন্ত্রী হওয়া ঠেকাতেই একাট্টা হয় বিভিন্ন দলের মধ্যে থাকা আনোয়ার বিরোধীরা। অন্যদিকে নিজের ‘ওয়াদা’ রক্ষার চেষ্টারত মাহাথিরের পক্ষেও পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকাটা অস্বস্তিকর হয়ে পড়ছিল।
এ অবস্থায় তিনি পদত্যাগ করলেও ২৯ ফেব্রুয়ারি আনোয়ার ইবরাহিমের সমর্থন পান নতুন সরকার গঠনের ব্যাপারে। কিন্তু একই দিনে বিকালের দিকে মালয়েশিয়ার রাজপ্রাসাদ থেকে মাহাথিরের দল পিপিবিএমের মুহিউদ্দীন ইয়াসিনকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করায় আনোয়ার ইবরাহিমের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথ আরো সরু হয়ে গেল।
মুহিউদ্দীন ইয়াসিনকে তাঁর পিপিবিএম, আনোয়ারের পিকেআরের একটি অংশ, ইউএনএমও এবং ইসলামি দল পিএএস সমর্থন দিচ্ছে। ফলে বলা যায় ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়ার ২ বছরের মাথায় ইউএনএমও পুনরায় ক্ষমতার কাছাকাছি চলে এলো।