ক্ষুদ্র পরিসরে বাড়ি-ঘরে অল্প পরিমাণে কোন পণ্য তৈরি করাকেই বলা হয়ে থাকে কুটির শিল্প। কুটির শিল্পের মাধ্যমে আবহমান বাংলার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং ইতিহাস ফুটে উঠে। তাই এটি বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী শিল্প। কুটির শিল্পকে হস্তশিল্প, কারুশিল্প, সৌখিন শিল্পকর্ম, গ্রামীণ শিল্পও বলা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)-এর মতে- ‘যে শিল্প কারখানা একই পরিবারের সদস্য দ্বারা পূর্ণ বা আংশিকভাবে পরিচালিত এবং পারিবারিক কারিগর খন্ডকালীন বা পূর্ণ সময়ের জন্য উৎপাদন কার্যে নিয়োজিত থাকেন এবং যে শিল্পে শক্তিচালিত যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হলে ১০ জনের বেশি এবং শক্তি চালিত যন্ত্র ব্যবহৃত না হলে ২০ জনের বেশি কারিগর উৎপাদন কার্যে নিয়োজিত থাকে না তাই কুটির শিল্প’। শিল্পনীতি ২০১০-এ বলা হয়েছে, ‘যেসব প্রতিষ্ঠানে জমি এবং কারখানা ব্যতিরেকে স্থায়ী সম্পদের মূল্য প্রতিস্থাপন ব্যয়সহ ৫ লক্ষ টাকার নীচে এবং পারিবারিক সদস্য সমন্বয়ে সর্বোচ্চ জনবল ১০-এর অধিক নয় এরূপ শিল্প প্রতিষ্ঠান হচ্ছে কুটির শিল্প।’
কুটির শিল্পের ইতিহাস
বঙ্গদেশে কুটির শিল্পের শুরু হয় পৃথিবীখ্যাত মসলিন কাপড় উৎপাদন দিয়ে। মুঘল যুগ থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য পর্যন্ত মূলত সুতিবস্ত্র উৎপাদনই ছিলো এই অঞ্চলের প্রধান কুটির শিল্প। দেশভাগের পর কুটির শিল্পের উৎপাদন এবং আমদানি-রপ্তানি কমে যায়। ১৯৫৭ সালে সরকারি আইনের মাধ্যমে ‘পূর্ব পাকিস্তান ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা (ইপসিক)’ প্রতিষ্ঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের পর পূর্ব পাকিস্তান ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থাকে পুনর্গঠন করে নতুন নামকরণ করা হয় ‘বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)’।
বিভিন্ন ধরনের কুটির শিল্প
মৃৎ শিল্পঃ মৃৎ শিল্পের মধ্যে মাটির তৈরি বিভিন্ন পুতুল, দেবদেবীর মুর্তি, গার্হস্থ্য দ্রব্যাদি, মাটির ভাস্কর্য, টালি, শখের হাঁড়ি, মনশাঘট ও ফুলদানি ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য মৃৎ শিল্প পল্লী কুমিল্লার বিজয়পুর, পটুয়াখালীর মদনপুরা, ফেনীর চম্পকনগর, শরিয়তপুরের কার্ত্তিকপুর এবং ঢাকার রায়ের বাজারে অবস্থিত।
বস্ত্র শিল্পঃ দেশীয় বস্ত্র শিল্পের মধ্যে রয়েছে শাড়ি, লুঙ্গি, ধুতি, গামছা, মশারি, তোয়ালে, ইত্যাদি। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী বস্ত্রের মধ্যে রয়েছে- উপজাতীয় বস্ত্র, মসলিন, জামদানী, মলমল টরোয়ো শাড়ি, পাবনার শাড়ি, টাঙ্গাইলের শাড়ি, কাতান, রেশমবস্ত্র, খদ্দর বস্ত্র ইত্যাদি।
পাটজাত শিল্পঃ পাট দিয়ে বিভিন্ন মোটিভের সিকা, টেবিলম্যাট, শতরঞ্জি, কার্পেট, সৌখিন হ্যান্ডব্যাগ, থলে ইত্যাদি তৈরি করা হয়। এসব পণ্য পাটজাত পণ্য হিসেবে পরিচিত।
বাঁশ-বেত শিল্পঃ বাংলাদেশের বাঁশ ও বেত শিল্পের মাধ্যমে সাধারণত বাঁশ বেত সামগ্রী, বেড়া, চাটাই, মাছধরার ফাঁদ, হাতপাখা, মোড়া, সোফাসেট, টেবিলম্যাট, ওয়ালম্যাট, ট্রে, ফুলদানি, ছাইদানি ইত্যাদি তৈরি করা হয়।
শীতলপাটিঃ শীতলপাটি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী একটি কারু শিল্প। মুলত এটি এক ধরণের চাটাই যেখানে আবহমান গ্রাম বাংলার প্রকৃতি, রূপ এবং সৌন্দর্যকে কারুকাজের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়।
গহনা শিল্পঃ বাংলাদেশের নারীদের অন্যতম পছন্দ হাতে তৈরি বিভিন্ন গহনা সামগ্রী। এসবের মধ্যে রয়েছে সিঁথিতে ঝাপা, কানে কানপাশা, হীরাম মুল কুড়ি, ঝুমকা, নবরত্ন ও চক্রবালি, নাকে বেশর নথ, ফুরফুরি, গলায় পুষ্পহার, সীতাহার, সাতনরীহার, চম্পাকলি, মোহনমালা, হাতে তাগা, মাদুলি বাজার মান্তাশা, রত্নচূড়, আঙ্গুলে আঙ্গুষ্ঠার শাহনামী, অ্যানওয়ান, কোমরে বিছা, চন্দ্রহার কিন্ধিনী পায়ে, ঝাঝুরা পায়েল, তোড়া ইত্যাদি।
কাঁসা-পিতলজাত শিল্পঃ ঢাকার ধামরাই, সাভার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জামালপুরের ইসলামপুর, রংপুর, টাঙ্গাইল ও শরিয়তপুরে পারিবারিক শিল্প হিসেবে বংশ পরম্পরায় কাঁসা ও পিতলের বিভিন্ন দৈনন্দিন ব্যবহার সামগ্রী তৈরি হয়ে আসছে।
নকশী কাঁথাঃ প্রাচীনকাল থেকে এদেশে বিভিন্ন ধরণের নকশী কাঁথা তৈরি হয়ে আসছে, যা এখন লাভজনক শিল্পে পরিণত হয়েছে। মুলত তিন ধরনের নকশি কাঁথা এদেশে তৈরি হয়: চিত্রিত কাঁথা, মাটিকাঁথা ও পাইড় কাঁথা।
This article is made possible by the support of the American People through the United States Agency for International Development (USAID.) The contents of this article are the sole responsibility of the Quizards project and do not necessarily reflect the views of USAID or the United States Government.