“স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক” – স্লোগানটির সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। এ স্লোগানটি বুকে ও পিঠে ধারণ করে তৎকালীন স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে (১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর) শহীদ হয়েছিলেন অকুতোভয় এক মানুষ। নূর হোসেন তাঁর নাম। সেই থেকে তিনি যেন গণতন্ত্রের আরেক নাম। তাঁরই স্বরণে প্রতি বছর ১০ নভেম্বর শহীদ নূর হোসেন দিবস পালিত হয়।
আজকের লেখায় নেয়া যাক নূর হোসেন সম্পর্কে। এখানে তাঁর ক্ষণজন্মা জীবনের বিভিন্ন দিকের উপর উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
শহীদ নূর হোসেন: যেভাবে শুরু
নূর হোসেনের পৈতৃক নিবাস পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার সাপলেজা ইউনিয়নের ঝাটিবুনিয়া গ্রামে। তাঁর বাবার নাম মজিবুর রহমান ওরফে কাঞ্চন মিয়া আর মায়ের নাম মরিয়ম বেগম। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়। নূর হোসেনের জন্ম ১৯৬৪ সালে ঢাকার নারিন্দায়।
মজিবুর রহমান ঢাকায় আসেন ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি। এরপর থেকে ষাট ও সত্তরের দশকে তিনি সব রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন।
যদিও দারিদ্র্য ছিলো নূর হোসেনের পরিবারের নিত্যদিনের সঙ্গী, তবু তিনি চেয়েছিলেন লেখাপড়া শিখতে। যার ফলে তাঁকে ভর্তি করা হয় বাড়ির পাশের রাধা সুন্দরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। জ্ঞানপিপাসু নূর হোসেন পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর ভর্তি হন গ্র্যাজুয়েট হাই স্কুলে। অভাবের তাড়নায় বেশি দূর পড়ালেখা করতে পারেননি। অষ্টম শ্রেণি শেষ করার পর পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে মোটর মেকানিকের কাজে যোগ দিতে হয়েছিলো। পেশা হিসেবে তিনি মিনিবাস সমিতি চালিত বাসের সুপারভাইজার হিসেবেও দীর্ঘদিন কাজ করেছেন।
কাজের ফাঁকে নূর হোসেন নিজ উদ্যোগে সদরঘাটের কলেজিয়েট নৈশ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। আস্তে আস্তে রাজনীতিতে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। তখন থেকেই বিভিন্ন মিটিং মিছিলে যোগদান করতেন। নেতৃত্ব দিতেন।
স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক
১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ঢাকা মহানগরী অবরোধ ও ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করে। এর বিপরীতে সরকারের পক্ষ থেকে ৯ নভেম্বর সকাল ৬টা থেকে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত সাতদিনের জন্য পাঁচ বা ততোধিক ব্যক্তির সমাবেশ, মিছিল, বিক্ষোভ প্রদর্শন ও সকল প্রকার অস্ত্র-শস্ত্র, বিস্ফোরক দ্রব্য, লাঠিসোটা বহন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। আর এ আদেশ বলবৎ করার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োগ করা হয়।
যে স্লোগান বুকে-পিঠে লিখে গণতন্ত্রের আন্দোলনে জীবন্ত পোস্টার হয়ে ইতিহাস হয়ে আছেন, সেই স্লোগান নূরের গায়ে সাদা রঙ দিয়ে লিখে দিয়েছিলেন তারই বন্ধু মো. ইকরাম হোসেন। লেখার সময় নূর হোসেনকে বলেছিলেন, “এভাবে বুকে-পিঠে লিখলে পুলিশ যদি তোকে গুলি করে?” প্রতি উত্তরে নূর বলেছিলেন, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের জন্য প্রায় সারা জীবন জেল খেটেছেন, অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন। আমি কেন পারবো না! আমি গণতন্ত্রের জন্য শহীদ হতে প্রস্তুত।”
ঐদিন সকাল ৯টা পর্যন্ত ঢাকা মহানগরীর সর্বত্র জীবনযাত্রা ছিলো মোটামুটি স্বাভাবিক। সকাল ৯টার দিকে তোপখানা রোড পুলিশ বক্সের অদূরে সিপিপি অফিসের সামনে কিছু লোক জমায়েত হলে পুলিশ সেখান থেকে প্রায় ২০ জনকে আটক করে। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে থেকে প্রায় দু’শ লোকের মিছিল শুরু হয়ে পুলিশ বক্সের দিকে এগুতে থাকে। এ সময় পুলিশ হাউজ বিল্ডিং ফিন্যান্স কর্পোরেশন ভবনের সামনে লাঠিচার্জ করে। এরপর থেকে মিছিলে লোক সংখ্যা বাড়তে থাকে। তোপখানা রোডের পুলিশ বক্স থেকে গোলাপ শাহ মাজার পর্যন্ত লোক জমায়েত হতে থাকে।
স্বৈরাচারী সরকার পতনের জন্য সংগঠিত সুবিশাল মিছিলের প্রধান ফোকাস ছিলেন একজন সাধারণ বেবিট্যাক্সি চালকের ছেলে বাংলার ইতিহাসের এক অদম্য সাহসী বীর কালো বর্ণের, লম্বা টগবগে যুবক নূর হোসেন। সেদিন তার চোখেমুখে যেন ছিলো আগুনের ফুলকি। বুকে-পিঠে লেখা ছিল স্বাধীন বাংলার জনগণের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি।
পায়ে কেডস জুতা, পরনে জিন্সপ্যান্ট, কোমড়ে বাঁধা শার্ট, উদোম গতর, বুকে পিঠে লেখা অমর বাণী। সত্যিই জনতার মাঝে সেদিন এক অন্য রকম মুখ ছিলেন তিনি। সকলের চোখে পড়েছিলো তা। ফাঁকি দিতে পারেননি স্বৈরশাসকের লেলিয়ে দেয়া পুলিশ বাহিনীর চোখকেও। মিছিলটি যখন গুলিস্তান জিরো পয়েন্টের কাছাকাছি পৌঁছায়, ঠিক তখনই শুরু হয় মিছিলের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণ। একটি গুলি এসে ছিদ্র করে দেয় নূর হোসেনের বুক।
বায়তুল মোকাররমের মূল গেটের কাছে মুহূর্তের মধ্যে লুটিয়ে পড়েন নূর হোসেন। মরণ যন্ত্রণায় ছটফট করা নূর হোসেনকে সুমন নামে এক যুবক রিকশায় করে হাসপাতালের দিকে যান। গুলিস্তানের গোলাপ শাহ মাজারের কাছে পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় স্বৈরাচারীর পুলিশ বাহিনী। তাদের কয়েকটি গাড়ি এসে রিকশাটিকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে। গুলিবিদ্ধ নূর হোসেনকে টেনে হিঁচড়ে রিকশা থেকে নামিয়ে পুলিশ গাড়িতে তুলে নেয়। একজন নিষ্ঠুর পুলিশ সদস্য পায়ের বুট দিয়ে তাঁর বুকে চেপে ধরে। এরপর নূর হোসেনকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরে সম্ভবত বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নিতে বাধ্য হন বাংলার এই সাহসী বীর সন্তান।
বাড়তি তথ্য
– নূর হোসেন ছাড়াও ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নিহত হন যুবলীগের নেতা নূরুল হুদা বাবুল ও কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের ক্ষেতমজুর নেতা আমিনুল হুদা টিটো।
– বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ভক্ত নূর হোসেনের পিতা কাঞ্চন হাওলাদার নিজের পিতৃপ্রদত্ত নাম পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধুর নামের সঙ্গে মিল রেখে নিজের নামকরণ করেন মজিবুর রহমান।
– শহীদ নূর হোসেনের স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে মৃত্যুর দিনটিকে পরবর্তীতে গণতন্ত্র দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ১৯৯৬ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নূর হোসেনের মৃত্যুর জন্য জাতীয় সংসদে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তার দল জাতীয় পার্টি ১০ নভেম্বরকে গণতন্ত্র দিবস হিসেবে পালন করে।
– যে স্থানে পুলিশের গুলিতে নিহত হন, তার নামানুসারে গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টের নামকরণ করা হয় নূর হোসেন চত্বর।
– জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ নূর হোসেনের একটি ম্যুরাল রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ভাস্কর্যে বিভিন্ন শহীদ, জাতীয় বীর, জগৎবিখ্যাত বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিকদের ভাস্কর্যের সঙ্গে স্থান পায় শহীদ নূর হোসেনের ভাস্কর্য। এর শিল্পী ভাস্কর শামীম সিকদার।
– শহীদ নূর হোসেনের আত্মত্যাগ বাংলাদেশের নেতাকর্মী, লেখক, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিকসহ নানা শ্রেণির মানুষকে আলোড়িত করেছিলো দারুণভাবে। তাঁকে নিয়ে লেখা হয় বহু কবিতা, গল্প, গান আর নাটকও। বুকে ও পিঠে লেখা স্লোগানটি সারাদেশের জনতার স্লোগানে পরিণত হয়। এ সংগ্রামের ধারাতেই ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর স্বৈরাচারী শাসক পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এর মধ্যে দিয়ে স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটে। দেশে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় গণতন্ত্র।