ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণিতবিদদের তালিকায় কার্ল ফ্রেডরিক গাউস উজ্জ্বল এক নাম। তাঁর পরিচয় দেবার আগে একটা ছোট ঘটনা দিয়ে শুরু করি! ছোটবেলায় তিনি ছিলেন খুব অস্থির প্রকৃতির। এজন্য ক্লাসের শিক্ষকদের খুব অসুবিধা হতো। তাই কিশোর গাউসকে ব্যস্ত রাখার জন্য একবার এক শিক্ষক “1+2+3………+100” এর ধারার যোগফল নির্ণয় করতে বললেন। তিনি আশা করেছিলেন যে অনেকগুলো সংখ্যা লিখে যোগ করতে গাউসের বেশ কিছুটা সময় লাগবে। শিক্ষককে ভুল প্রমাণ করেছিলেন গাউস। তিনি লক্ষ করলেন যে ধারাটি একেবারে সোজা – একবার উল্টো দিক থেকে লিখলে প্রতি জোড়া সংখ্যার যোগফল সমান হয়!
S=1+2+3+………+100
S=100+99+98+….+1
______________________________________________________________________________
2S= 101+101+101+……..+101
or, 2S= 101.100
or, S= 50.101=5050
দুই মিনিটের মাথায় গাউস শিক্ষকের কাছে সমস্যার সমাধান দিয়ে আসলেন। শিক্ষক অবাক হলেন। এ সমস্যার সমাধান করতে গাউসের কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ মিনিট লাগার কথা। নিজের ছাত্রের পদ্ধতি বুঝতে শিক্ষকের পর্যন্ত বেশ সময় লেগেছিলো!
খুব কম বয়সে কার্ল ফ্রেডরিক গাউস এমন মেধারই পরিচয় দিয়েছিলেন। গণিতের খুব কম শাখা আছে যেখানে তাঁর অবদান নেই। সংখ্যা তত্ত্ব, বীজগণিত, পরিসংখ্যান, গাণিতিক বিশ্লেষণ, ডিফারেন্সিয়াল জ্যামিতি, জিওফিজিক্স, স্থির তড়িৎ, জ্যোতির্বিদ্যা, ম্যাট্রিক্স থিওরি ও অপটিক্সে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন তিনি।
জন্ম হোক যথা তথা…
সাধারণত ইউরোপের বড় গণিতবিদ, বিজ্ঞানী, শিল্পী-সাহিত্যিকদের পারিবারিক ঐতিহ্য থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু কার্ল ফ্রেডরিক গাউস এসেছিলেন একেবারে সাধারণ এক শ্রমিক পরিবার থেকে। ১৭৭৭ সালের ৩০ এপ্রিল জার্মানির ব্রান্সউইক শহরে জন্ম তাঁর। তাঁর বাবা ছিলেন মালি, শ্রমিক ও ফোরম্যান – অশিক্ষিত ও কথাবার্তায় অমার্জিত। এক অর্থে গাউসের সৌভাগ্য যে তাঁর বাবা ছেলের প্রতিভা বুঝতে পারেন নি। বুঝতে পারলে নিশ্চিতভাবেই তাঁর শিশু প্রতিভাকে বাজারজাত করার চেষ্টা করতেন হয়তো – এমনটাই ধারণা অনেকের।
গাউসের মা ছিলেন স্বল্পশিক্ষিত। গাউসের জন্ম তারিখ তিনি কোথাও লিপিবদ্ধ করেন রাখেন নি। তাঁর শুধু খেয়াল ছিলো যে গাউস কোন এক বৃহস্পতিবারে জন্মেছিলেন, “Feast of Ascension”-এর (জীবিত অবস্থায় যীশুর স্বর্গে উত্থান) আট দিন আগে, ইস্টারের ৩৯ দিন পর। পরবর্তীতে ইস্টারের দিন বের করতে গিয়ে গাউস তাঁর নিজের জন্মতারিখ বের করতে সক্ষম হন!
১১ বছর বয়সে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল শেষ করার পর হাই স্কুলে (সেখানে বলা হয় জিমনাসিয়াম) যাবার জন্য গাউসের বাবাকে অনেক কষ্টে রাজি করাতে হয়েছিলো। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় তিনি হাই স্কুলে অসম্ভব ভালো করলেন। ১৪ বছর বয়সে তিনি তাঁর শহরের ডিউক থেকে একটি বৃত্তি পেলেন। ফলে পড়াশুনার খরচ নিয়ে তাঁর চিন্তা-ভাবনা কমে যায়।
… কর্ম হোক ভালো
১৭৯২ সালে গাউস ব্রান্সউইকের কার্নোলিয়াম কলেজে ভর্তি হলেন। সেখানে ৩ বছর ছিলেন তিনি। তাঁর বিখ্যাত প্রাইম নাম্বারের সূত্র তিনি সে সময় দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত প্রায় একশ বছর পর প্রমাণিত হয়েছিলো সূত্রটি!
কলেজ শেষ করে গাউস গটিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এলেন। কলেজে বইপত্র-জার্নাল সেরকম ছিলো না। কিন্তু গটিনজেনে এসে সেগুলো তাঁর নাগালে চলে এলো। অসীম আগ্রহে তিনি সেগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করতেন। প্রায়ই অবাক হয়ে দেখতেন, তাঁর অনেক আবিষ্কারই অন্য কেউ আবিষ্কার করে রেখেছে। সে সময়ে গটিনজেনে যেসব গণিতবিদ ছিলেন, তাদের মেধা খুব একটা ভালো ছিলো না। এমন অবস্থা দেখে গাউসের এতটা মোহভঙ্গ হয়েছিলেন যে মাঝখানে একবার ভাষাবিদ হবার পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেন! ঠিক তখন প্রায় দুই হাজার বছরের অসাধ্য একটি সমস্যার সমাধান করে (রুলার ও কম্পাস ব্যবহার করে সম-সতেরোভুজ আঁকা) সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেন। ১৭৯২ সালে অসাধারণ এ আবিষ্কার করেন তিনি।
১৭৯৮ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে কার্ল ফ্রেডরিক গাউস তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ বই, ম্যাগনাম অপাস, Disquisitiones Arithmeticae (ল্যাটিন – Arithmatical Investigations) লেখেন। ১৮০১ সালে প্রকাশিত হয় বইটি। সংখ্যাতত্ত্বের উপর লেখা এ বই গণিতের উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখে।
বামন গ্রহের সন্ধানে
ইতালীয় জ্যোতির্বিদ জুসেপ্পে পিয়াজ্জি ১৮০১ সালে বামন গ্রহ সেরিস আবিষ্কার করেন। কিন্তু তিনি শুধু এক মাসের জন্য এর গতিপথ ট্র্যাক করতে পারলেন। রাতের আকাশে তিন ডিগ্রি দৃষ্টিসীমার মধ্যে সেটিকে পর্যবেক্ষণ করেন তিনি। এরপর এটি সূর্যের ঝলকানিতে সাময়িকভাবে হারিয়ে যায়। কয়েক মাস পর, যখন সেরিসকে আবার দেখতে পাবার কথা, তখন পিয়াজ্জি বামন গ্রহটিকে খুঁজে পেলেন না। সে সময়কার গণিত গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান সঠিকভাবে বের করার মতো অগ্রসর ছিলো না। পুরো কক্ষপথের ১% এরও কম ছিলো তিন ডিগ্রি দৃষ্টিসীমা!
গাউসের বয়স তখন ২৪। তিনি সমস্যাটির কথা জানতে পেরে এর সমাধানে আগ্রহী হলেন। তিন মাসের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর ১৮০১ সালের ডিসেম্বরে সেরিসের জন্য একটি অবস্থান ভবিষ্যদ্বাণী করেন – এর প্রথম পর্যবেক্ষণের প্রায় এক বছর পর। সঠিক ছিলেন গাউস। ৩১ ডিসেম্বর ভন জ্যাক ও তার একদিন পর হাইনরিখ অলবার্স আবারো সেরিসকে খুঁজে পান!
নিঃসঙ্গ এক প্রতিভা
গাউস খুব একটা ভালো লেখক ছিলেন না। লেখা অসম্পূর্ণ মনে করলেই বা সম্ভাব্য সমালোচনার কথা বিবেচনা করে সেগুলো তিনি প্রকাশ করতেন না। সমসাময়িক অনেকের আগেই গাউস বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গাণিতিক আবিষ্কার করে রেখেছিলেন। নন-ইউক্লিডীয় জ্যামিতির প্রথম ধারণা দিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীতে তাঁর ব্যক্তিগত ডায়েরি থেকে এসব তথ্য উদঘাটিত হয়। বলা হয়ে থাকে, তিনি যদি তাঁর আবিষ্কারগুলো ঠিক সময়ে প্রকাশের ব্যবস্থা নিতেন, তাহলে গণিত আরো ৫০ বছরে এগিয়ে থাকতো।
শিক্ষকতা অপছন্দ ছিলো গাউসের। ১৮২৮ সালে তিনি বার্লিনে প্রথম ও শেষবারের মতো একটি বিজ্ঞান সম্মেলনে যোগ দেন। তাঁর বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী পরবর্তীতে প্রভাবশালী গণিতবিদ হিসাবে পরিচিতি পান। তাঁদের মধ্যে বার্নহার্ড রিম্যান (অত্যন্ত বিখ্যাত রিম্যান হাইপোথিসিসের জনক) ও ফ্রেডিখ বেসেল উল্লেখযোগ্য। মৃত্যুর আগে তিনি সোফি জার্মেইনকে সম্মানজনক ডিগ্রির জন্য সুপারিশ করে যান।
গাউস নিজে নিজে কাজ করতেন। ধীরে ধীরে এটা তাঁর কর্মজীবনের অংশ হয়ে গিয়েছিলো। তাঁর দীর্ঘ জীবনে কখনো তিনি অন্য কারো সাথে কাজ করেন নি। বড় গণিতবিদেরা যখন গাউসের সাথে কাজ করতে এসেছিলেন, ততদিনে একা একা কাজ করায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি।
ব্যক্তি গাউসের জীবন
গাউস কখনো আর্থিকভাবে সচ্ছল ছিলেন না। তাঁর কাজের ক্ষেত্র ছিলো অনেক। অর্থকষ্ট থেকে মুক্তি পাবার জন্য ভূমি-জরিপের মতো কাজও করতে হয়েছিলো তাঁকে। গণিতে তাঁর অসামান্য দখল দুনিয়াব্যাপী খ্যাতি এনে দিলেও মানুষ হিসেবে তিনি খুব অসুখী ছিলেন। ফরাসি বিপ্লব, নেপোলিয়নের আবির্ভাব, জার্মানিতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সময় তিনি রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল ও অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। প্রথম স্ত্রীর অকাল মৃত্যু, অসুস্থ দ্বিতীয় স্ত্রী, সন্তানদের সাথে খারাপ সম্পর্ক – সব মিলিয়ে তাঁর জীবন ছিলো অত্যন্ত জটিল। গাউসের প্রথম স্ত্রী বেঁচে থাকার সময় অবশ্য এমন অবস্থা ছিলো না। তৃতীয় সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে তাঁর স্ত্রী মারা যাবার পর তাঁর মন একেবারে ভেঙে যায়। গভীর দুঃখে নিমজ্জিত হন এ গণিতবিদ। আর কখনো সে দুঃখ ও নিঃসঙ্গতা থেকে তাঁর মুক্তি হয় নি।
গাউস ছিলেন একজন লুথেরান প্রটেসট্যান্ট। চার্চে না গেলেও ধর্মীয় সহিষ্ণুতার উপর তিনি খুব গুরুত্ব দিতেন। মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো। তিনি মনে করতেন আধ্যাত্মিকতা মানুষের জন্য খুব প্রয়োজনীয় একটা ব্যাপার। তিনি বলেছিলেন, “The world would be nonsense, the whole creation an absurdity without immortality.”
১৮৫৫ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে কার্ল ফ্রেডরিক গাউস মারা যান। পৃথিবীতে তাঁর উপস্থিতি নেই এখন। কিন্তু গণিতের অবিস্মরণীয় জগতে তাঁর উপস্থিতি থেকে যাবে চিরদিন – এটাই হলো সুন্দর এক সত্য।
কার্ল ফ্রেডরিক গাউস: বোনাস তথ্য
– বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী উইলেম ওয়েবারের সাথে কাজ করে প্রথম ইলেকট্রোম্যাগনেটিক টেলিগ্রাফ তৈরি করেছিলেন গাউস।
– ১৮২১ সালে রয়েল সুইডিশ সায়েন্স একাডেমির বিদেশী সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।
– ১৯৯১ সালে ডয়েচে বুন্দেসব্যাংক (জার্মানির কেন্দ্রীয় ব্যাংক) গাউসের সম্মানে ১০ ডয়েচে মার্ক ব্যাংকনোট বের করে।
তথ্যসূত্র
BBC, (2010). Carl Friedrich Gauss. [podcast] A Brief History of Mathematics. Available at: http://www.bbc.co.uk/programmes/b00ss0lf [Accessed 11 Feb. 2016].
Gauss-goettingen, [No date]. GENIAL – GAUSS – GÖTTINGEN. [online] Available at: http://www.gauss-goettingen.de/index_en.php [Accessed 12 Feb. 2016].
Taylor, P. (1998). Carl Friedrich Gauss. [online] Australian Mathematics Trust. Available at: http://www.amt.edu.au/bioggauss.html [Accessed 11 Feb. 2016].