পৃথিবীর অধিকাংশ রাজনৈতিক ব্যবস্থাই পুরুষের নিয়ন্ত্রিত। একুশ শতকে নারীর ক্ষমতায়নের কালে অনেক শক্তিমান নারী নেত্রী ও রাজনীতিবিদকে আমরা দেখি। কিন্তু তথাকথিত আধুনিক যুগের শুরুতে কেমন ছিলো রাজনীতিতে নারীদের প্রভাব? আমরা যদি একটু ঘাঁটাঘাঁটি করি তাহলে দেখতে পাব সেসময়ও অনেক প্রভাবশালী নারীছিলোেন যাঁরা বিশ্বের রাজনীতিতে অবদান রেখেছেন। ১৫শ থেকে ১৯শ শতক পর্যন্ত সেরকম পাঁচজন নারীকে নিয়ে থাকছে এই লেখা।
জোন দ্য আর্ক (১৪১২-১৪৩১)
শতবর্ষের যুদ্ধে ফ্রান্স যখন ব্রিটিশ বাহিনীর হাতে পর্যুদস্ত, তখন এক সাধারণ কৃষক পরিবারের কিশোরী এসে ফ্রান্সের রাজা সপ্তম শার্লকে বললেন, স্বপ্নে তিনি দেবদূত মাইকেলের কাছ থেকে আদেশ পেয়েছেন ফরাসি বাহিনীকে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার। রাজার কী মনে হলো, তিনি মেয়েটিকে সেনাপতি করে পাঠালেন গুরুত্বপূর্ণ অরলিন্সের যুদ্ধে। অবিশ্বাস্যভাবে ১৪২৯ সালে মেয়েটির নেতৃত্বে ফরাসি বাহিনী যুদ্ধে জয়লাভ করে। শতবর্ষের যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায় এবং ফ্রান্স শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়।
এ কিশোরী মেয়েটিই জোন দ্য আর্ক, বিজয়ী ফ্রান্সের প্রতীক। ১৪৩১ সালে ইংল্যাণ্ডের হাতে ধরা পড়বার পর তাঁকে ডাইনী অপবাদ দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়। তখন তার বয়স মাত্র ১৯ বছর। পরবর্তীতে ক্যাথলিক চার্চ তাঁর বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ তুলে নেয়। তাঁকে সেইন্ট ঘোষণা করা হয়। এখনো ফ্রান্সে দেশপ্রেমের প্রতীক হিসেবে জোন দ্য আর্ক চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।
লক্ষ্মীবাঈ (১৮৩৫-১৮৫৮)
ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মীবাই ঔপনিবেশিক ভারতে ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহের প্রতীক। সিপাহী বিদ্রোহের কাছাকাছি সময়ে ব্রিটিশরা ঝাঁসির দখল নিতে উঠে-পড়ে লেগেছিল। তরুণী রাণী বীরদর্পে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে সিপাহী বিদ্রোহ জ্বলে উঠলে তিনি তাঁর সৈন্যসামন্ত এক করেন এবং বুন্দেলখণ্ড অঞ্চলে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে তিনি সামনে থেকে ভারতীয়দের নেতৃত্ব দেন। বিদ্রোহ চলাকালীন সময়েই ১৮৫৮ সালের ১৭ জুন একটি সম্মুখযুদ্ধে তিনি নিহত হন। মাত্র ২২ বছরের জীবনকালেই তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের জ্বলন্ত প্রতীকে পরিণত হয়েছিলেন।
ইসাবেল অব কাস্তিল (১৪৫১-১৫০৪)
কাস্তিলের রাণী ইসাবেল দুইটি কারণে ইউরোপের ইতিহাসে বিখ্যাত। প্রথম কারণটি হলো, তিনি প্রথম পুরো স্পেনকে একত্রিত করবার পিছনে ভূমিকা রাখেন। তিনি ও তাঁর স্বামী ফার্দিনান্দ একত্রে কাস্তিল ও আরাগন শাসন করেন, যার সুদূরপ্রসারী ফলাফল ছিলো এটি। তাঁর নাতিছিলোেন একত্রিত স্পেনের রাজা প্রথম কার্লোস (চার্লস)।
দ্বিতীয় কারণটি আমরা সবাই কমবেশি জানি। ইতালীয় এক্সপ্লোরার ক্রিস্টোফার কলম্বাস ঘুরতে ঘুরতে এসে হাজির হন ইসাবেলের রাজসভায়। তিনি রাণীকে রাজি করান তাঁকে একটি বড় সমুদ্রযাত্রায় যাবার রসদ ও জাহাজ যোগান দেবার। ফলশ্রুতিতে ১৪৯২ সালে কলম্বাস নিনা, পিন্টা ও সান্তা মারিয়া জাহাজ নিয়ে রওনা দেন সমুদ্রে, এবং ইউরোপের কাছে অজানা নতুন ভূখণ্ডে এসে পৌঁছান, যাকে আমরা আজ আমেরিকা বলে চিনি। এর মাধ্যমে ইউরোপের বাইরে স্পেনের কলোনি প্রসারণের সুযোগ ঘটে।
প্রথম এলিজাবেথ (১৫৩৩-১৬০৩)
ইংরেজ ইতিহাসবিদরা ইংল্যাণ্ডের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক হিসাবে গণ্য করেন রাণী প্রথম এলিজাবেথকে। তিনি যখন ক্ষমতায় আসেন তখন ইংল্যাণ্ডের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিলো অনেকটা দেউলিয়া হবার মত। তাঁর পলিসির কারণে ইংল্যাণ্ডের অর্থনীতি আবার ভাল অবস্থায় ফিরে আসে। প্রোটেস্টান্ট ও ক্যাথলিকদের দীর্ঘ দ্বন্দ্বের পর তাঁর সাড়ে ৪৪ বছরের শাসনামলে ইংল্যাণ্ডে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার মুখ দেখে। তাঁর শাসনামলে ইংল্যাণ্ডের নৌবাহিনী বিশাল স্পেনীয় নৌবহর স্প্যানিশ আর্মাডাকে পরাজিত করে। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় ইংল্যাণ্ডের কলোনি বিস্তার শুরু হয়। ইংরেজি সাহিত্যেরও বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনি, তাঁর আমলে এডমাণ্ড স্পেন্সার, উইলিয়াম শেক্সপীয়ার, ক্রিস্টোফার মার্লোসহ অনেক বড় বড় সাহিত্যিক উঠে আসেন। তিনি নিজেও ছিলেন ভাল লেখিকা ও রাজনৈতিক বক্তা। তাঁর বিখ্যাত বক্তৃতার মধ্যে টিলবারিতে সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্যে দেওয়া তার বক্তৃতা (Speech to the troops at Tilbury) উল্লেখযোগ্য। পুরুষতান্ত্রিক ইংলিশ সমাজে নিজের গুণে ও সাহসে প্রথম প্রভাবশালী নারী শাসক হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
রাণী ভিক্টোরিয়া (১৮১৯-১৯০১)
সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেনের রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে রাণী ভিক্টোরিয়ার প্রভাব এতই বেশি যে তাঁর শাসনকালকে ‘ভিক্টোরিয়ান যুগ’ হিসেবে প্রায় সবাই চিনি। রাণী ভিক্টোরিয়া যেমন ছিলেন আলোচিত তেমনি সমালোচিত। ব্রিটেন সাম্রাজ্যের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তাঁর হাত দিয়ে আসে। যেমন, তিনি ভারতবর্ষকে সরাসরি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন; এর আগে ভারতবর্ষছিলো কেবল ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির শাসনে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লর্ড মেলবোর্ণ এবং বেঞ্জামিন ডিজরেইলির প্রভাবশালী হয়ে ওঠার পিছনেও তাঁর অনুপ্রেরণাছিলো। তিনি নতুন করে রাজকীয় কিছু প্রথা শুরু করেন, যেগুলো এখনো মেনে চলা হয়। ক্রিমিয়ার যুদ্ধের সময় তিনি তাঁর নামে নতুন সম্মাননা পদক – ‘ভিক্টোরিয়া ক্রস’ চালু করেন। ব্রিটেনের রাজনীতিতে তাঁর বহুমুখী প্রভাব ছিলো। বিতর্কিত ও অজনপ্রিয় কিছু সিদ্ধান্তের কারণে তাঁর শাসনামলের শেষ দিকে ব্রিটেনে রিপাবলিকান আন্দোলনও গড়ে ওঠে।
This article is made possible by the support of the American People through the United States Agency for International Development (USAID.) The contents of this article are the sole responsibility of the Quizards project and do not necessarily reflect the views of USAID or the United States Government.