সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনায় এসেছেন রাইফেল হাতে গুলি ছোঁড়ার ভঙ্গিতে থাকা এক আইরিশ তরুণী।
ছবির ক্যাপশনে দাবি করা হচ্ছে –
- তার প্রেমিক, যিনি আয়ারল্যান্ডের ব্রিটিশ শাসনের বিরোধীদের একজন ছিলেন, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে একটি যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হবার পর এ তরুণী তার প্রেমিকের রাইফেল নিয়ে শত্রুদের দিকে গুলি করা শুরু করেন।
- তরুণীর প্রেমিককে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা দেয়া হলে তিনি বেঁচে যান; কিন্তু সে তরুণী মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ব্রিটিশ বাহিনীকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে থাকেন ও শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ বাহিনীর হাতে নিহত হন।
- ব্রিটিশ বাহিনীর কমান্ডার বিষয়টি জানার পর মন্তব্য করেন যে, “আমরা এমন এক রানির জন্য যুদ্ধ করি যিনি আমাদের জীবনের ব্যাপারে কোন পরোয়া করেন না। অন্যদিকে এ মেয়েটি তার প্রেমিক ও দেশকে ভালোবাসে।”
রক্তাক্ত রবিবার
ছবিটি দেখলে প্রথমেই মাথায় আসে ১৯৭২ সালের “Bloody Sunday” বা রক্তাক্ত রবিবারের কথা।
উত্তর আয়ারল্যান্ডের স্বাধিকারের জন্য আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির সদস্যরা বেশ কিছুদিন থেকেই অস্ত্রের ব্যবহার করে আসছিলেন। বহু ক্ষয়ক্ষতিও হচ্ছিলো জানমালের। তাই ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে উত্তর আয়ারল্যান্ডের প্রশাসন যেকোন নাগরিককে কোন সুস্পষ্ট অভিযোগ বা আইনি সুবিধা ছাড়াই গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা দিয়ে আইন প্রণয়ন করে। এ আইনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমতে থাকে উত্তর আয়ারল্যান্ডবাসীর মনে।
আইনটির প্রতিবাদে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি একটি বড় বিক্ষোভের আয়োজন করা হয় আয়ারল্যান্ডের শহর লন্ডনডেরিতে। প্রশাসন যেকোন বিক্ষোভ কর্মসূচি নিষিদ্ধ করে সেদিনের জন্য।
নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে সেদিন। রাস্তায় রাস্তায় সংঘর্ষ বাঁধে প্রতিবাদীদের সাথে। এমন অবস্থায় সেনাবাহিনীর প্যারাস্যুট রেজিমেন্ট বিক্ষোভকারীদের গ্রেপ্তার করা শুরু করলে ইট-পাটকেল-ঢিল ছোঁড়া শুরু হয় সেনাদের লক্ষ্য করে। পালটা ব্যবস্থা হিসেবে টিয়ারশেল-রাবার বুলেট আর প্রয়োজনে সরাসরি গুলিও ছোঁড়া শুরু করে সেনারা। গুলির আঘাতে ঢলে পড়তে থাকে বিক্ষোভকারীরা। কেউবা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটতে থাকে। অন্তত তেরো জন মারা যায় সেদিন। দিনটি ছিলো রবিবার।
এ ঘটনার পর উত্তর আয়ারল্যান্ডের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে সরকারবিরোধী মনোভাব প্রবল হয়। দলে দলে তারা যোগ দিতে থাকে আইরিশ রিপাবলিকান আর্মিতে। ছয় মাস পর জুলাই মাসে, উত্তর আয়ারল্যান্ডে রাজধানী বেলফাস্টে যুদ্ধে জড়ায় আইআরএ ও ব্রিটিশ-আইরিশ সেনাবাহিনীর জোট।
কে সেই তরুণী?
উত্তর আয়ারল্যান্ডের অধিবাসীদের একাংশের ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাবের কথা তো জানা গেলো। কিন্তু সেই তরুণী কে? তার প্রেমিকই বা কে? জানা যাক এ ছবির ফটোগ্রাফারের কাছ থেকেই।
ছবিটি ১৯৭২ সালে তোলেন আলোকচিত্রী কোলম্যান ডয়েল। তিনি ছবির ক্যাপশন দেন “A woman IRA volunteer on active service in West Belfast with an AR18 assault rifle” (পশ্চিম বেলফাস্টে এআর১৮ অ্যাসাল্ট রাইফেল নিয়ে দায়িত্বরত একজন নারী আইআরএ স্বেচ্ছাসেবক)। তিনি কারো হবু স্ত্রী ছিলেন বা তার প্রেমিক গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন – এমন কিছু ক্যাপশনের কোথাও বলা নেই।
সত্যানুসন্ধানী গণমাধ্যম স্নুপের কাছে ডয়েল সেদিনের স্মৃতিচারণা করেন। তিনি জানান, সেদিন তিনি উত্তর বেলফাস্টের রিপাবলিকানদের দুর্গ বলে পরিচিত আর্ডোয়নে প্রভিশনাল আইআরএ কমান্ডার মার্টিন মিহানের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তিনি যখন মূল শহরের দিকে ফিরছিলেন তখন হঠাৎ করেই এ তরুণীর উদয় ঘটে। পজিশন নিয়েই কাছাকাছি কোন সেনা টহলের দিকে দুটি গুলি ছোঁড়েন, এরপর যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যান। মাত্র দেড় মিনিটের মধ্যে পুরো ঘটনাটি ঘটে। ভাগ্যক্রমে নিজের ক্যামেরায় একটি ছবি তুলতে সক্ষম হন চার্লস ডয়েল।
চার্লস ডয়েলের মতে, এমন ঘটনা নতুন কিছু না। যেহেতু সরকারি সেনারা বড় দলে টহল দিতো, আইআরএ গেরিলারা এমন হিট অ্যান্ড রান কৌশল অবলম্বন করতো। সেদিনের সে তরুণী সম্পর্কে এর থেকে বেশি কিছুই জানা সম্ভব হয়নি তাঁর পক্ষে।
তাই বলা যায়, আবেগভরা প্রেমিকের গুলিবিদ্ধ হওয়া ও তার প্রেমিকার অস্ত্র হাতে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পটা পুরোটাই বানোয়াট।