জহির রায়হানের নাম শুনলে তাঁর কোন পরিচয়টির কথা প্রথমে মাথায় আসে আপনাদের? বলা মুশকিল৷ একাধারে সাংবাদিকতা, সাহিত্য, চলচ্চিত্র, তথ্যচিত্র সব ক্ষেত্রেই সমান মুন্সিয়ানার ছাপ রেখে গেছেন যিনি, এক শব্দে তাঁকে বোঝানো আসলে অসাধ্য৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যের উপর স্নাতক সম্পন্ন করে সাংবাদিক হিসেবে পেশাজীবনের শুরু করেন তিনি৷ ধীরে ধীরে বিস্তৃত হতে থাকে তাঁর কর্মক্ষেত্র৷ লেখালেখি এবং চলচ্চিত্র নির্মাণে ঝুঁকে পড়েন তিনি৷
অল্প বয়সেই কম্যুনিস্ট রাজনীতিতে আকৃষ্ট হন৷ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল৷ ২১শে ফেব্রুয়ারি যে দশ জন প্রথম ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেন, তিনি তাঁদের অন্যতম৷ বাকিদের সঙ্গে তাঁকে মিছিল থেকে গ্রেফতার করে কারারুদ্ধ করা হয়৷
বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রভাব তাঁর সৃষ্টিতে দৃশ্যমান৷ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের উপর ‘আরেক ফাল্গুন’-এর মতো উপন্যাস, ‘একুশের গল্প’-এর মতো ছোটগল্প এবং ‘জীবন থেকে নেওয়া’-এর মতো সিনেমা এসেছে এই একজন মানুষের মাথা থেকেই৷ চলচ্চিত্রকার ও সাংবাদিক হিসেবে তিনি নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের ওপর “স্টপ জেনোসাইড” ডকুমেন্টারিটির নির্মাণ করে৷ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর চালানো গণহত্যার প্রামাণ্য চিত্র পৃথিবীজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে৷
‘আরেক ফাল্গুন’ উপন্যাসের শেষ লাইনে “আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হব” উক্তিটি তাঁর সামগ্রিক রচনার মধ্যে স্মরণীয়তম৷ আইয়ুব খানের রাজনৈতিক একনায়কতন্ত্রের রূপক হিসেবে “জীবন থেকে নেওয়া” ছবিতে “এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে” গানটির ব্যবহার তাঁর শিল্পিত প্রতিবাদ৷
তাঁর রচনা প্রসঙ্গে হুমায়ূন আজাদ রায় দিয়েছিলেন যে, জহির রায়হান সম্ভবত বাংলাদেশের একমাত্র কথাসাহিত্যিক যাঁর উদ্ভবের পেছনে রয়েছে ভাষা আন্দোলন৷ যদি বায়ান্নর একুশ না ঘটতো তাহলে জহির রায়হান হয়ত কথাশিল্পী হতেন না৷
কেবল রাজনৈতিক সচেতনতাই না, পপুলার কালচারের রুচিশীল চর্চাও দেখা যায় তাঁর সৃষ্টিতে৷ ১৯৫৯ সালে অবিভক্ত পাকিস্তান থেকে প্রথম যে ছবিটি অস্কারে গিয়েছিল, সেই ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক ছিলেন তিনি (চলচ্চিত্রে তাঁর প্রথম সরাসরি সংশ্লিষ্টতাও এটি)৷ তাঁর একক পরিচালনায় প্রথম চলচ্চিত্র ‘কখনো আসেনি’ মুক্তি পায় ১৯৬১ সালে৷ ১৯৬৪তে তাঁর হাত ধরেই এসেছিল তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম রঙিন ছবি “সঙ্গম”৷ লোককাহিনীনির্ভর ব্যবসাসফল ছবি ‘বেহুলা’-এর নির্মাতাও তিনি৷ ‘Let There Be Light’ নামে একটি ইংরেজি ছবির নির্মাণও শুরু করেছিলেন৷ কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় তা স্থগিত করতে হয়৷ বলাই বাহুল্য, ছবিটি তিনি আর শেষ করতে পারেন নি৷
রোম্যান্টিক উপন্যাস ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’, পঞ্চাশের দশকের বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত পরিবারের আলেখ্য ‘বরফ গলা নদী’ কিংবা আবহমান বাংলার গ্রামীণ জীবন ও মানুষ নিয়ে লেখা ‘হাজার বছর ধরে’ – জহির রায়হানের উপন্যাসের বিষয় বিচিত্র৷ বেশ কিছু ছোটগল্পও লিখেছেন তিনি৷ ‘সময়ের প্রয়োজনে’, ‘একটি জিজ্ঞাসা’, ‘মহামৃত্যু’, ‘হারানো বলয়’ এর মাঝে কয়েকটি৷ ছোট ছোট সরল বাক্য ও নির্মেদ ভাষা তাঁর ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য৷
১৯৭২ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান৷ বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ১৯৭৭ সালে মরণোত্তর একুশে পদক এবং ১৯৯২ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করে৷ এছাড়াও ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসের জন্য তিনি আদমজী পুরস্কার পেয়েছিলেন৷
মাত্র ছত্রিশ বছরের জীবনে যা যা করে গেছেন, তা বিস্ময় জাগায় বারবার৷ একইসাথে, আক্ষেপও৷
১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট জন্ম নেওয়া এ মানুষটি বেঁচে থাকলে আজ ৮৩ বছর পূর্ণ করতেন৷ জন্মদিনে জহির রায়হানকে অশেষ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করছে কুইজার্ডস পরিবার৷
লিখেছেন সুবাহ সেমন্তী