“Imagine”গানটি যারা শুনেছেন, তারাই মজে গেছেন জন লেননে। ঊনিশশো ষাটের দশকে আবির্ভূত গ্রহের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যান্ড দ্য বিটলসের অন্যতম সদস্য তিনি। সদা উচ্ছল চার তরুণের কালোত্তীর্ণ এ ব্যান্ড টিকে ছিলো মাত্র ১০ বছর। ১৯৭০ সালে ভেঙে যায় বিটলস। সদস্যরা ব্যক্তিগত ক্যারিয়ার গড়ার জন্য সরে যান একে অপরের কাছ থেকে। জন লেননও থেমে থাকেননি। তাঁর এলোমেলো চুল আর আইকনিক সানগ্লাস ভক্তদের মন জয় করে নিয়েছিলো অনেক আগেই। শান্তি আর মানবতার থিম নিয়ে তাঁর গাওয়া গানগুলো শ্রোতারা লুফে নেয়। তবে তাঁর জীবনের সমাপ্তি শান্তিপূর্ণ ছিলো না। কেমন ছিলো জন লেননের শেষ রাত – আজকে সেটাই জানবো আমরা।
নিজের একক সঙ্গীত জীবনে একে একে উপহার দেন “Instant Karma!”, “Jealous Guy”, “Give Peace a Chance”-এর মতো গান। আর ১৯৭১ সালে মুক্তি পাওয়া “Imagine” গানটির কথা তো শুরুতেই বলা হয়েছে। লেলনের গানের উপজীব্য ছিলো ভেদাভেদহীন মানব সমাজের স্বপ্ন। যুদ্ধবিরোধী মনোভাবের কারণে মার্কিন সরকারের রোষানলের শিকার হন এ ব্রিটিশ তারকা।
জনপ্রিয় হবার পর পাগল ভক্তদের সামাল দিতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হতো চার বিটলকে। ভক্তদের চূড়ান্ত পাগলামির জন্য প্রত্যেকেই নানা বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হন। শেষ পর্যন্ত এমন এক উন্মাদ ভক্তের কারণে জন লেননকে চড়া মাশুল দিতে হয়।
শেষের শুরু যেখানে
টেক্সাসে জন্ম নেয়া উদভ্রান্ত এক যুবকের গল্প বলা যাক। নাম তার মার্ক ডেভিড চ্যাপম্যান। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছেলেটির শৈশব ছিলো ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ। ১৯৭৭ সালে চ্যাপম্যান হাওয়াইয়ে চলে যায়। সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি জুটিয়ে ফেলে সেখানে। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় গ্লোরিয়া নামের এক মেয়ের সাথে। কিন্তু মানসিক অস্থিরতা কিছুতেই পিছু ছাড়ছিলো না। কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে মরতে মরতে বেঁচে যায় চ্যাপম্যান। হঠাৎ ঠিক করে নিউ ইয়র্কে ঘুরতে যাবার।
চ্যাপম্যান বিটলসের বিশাল ফ্যান। নিউ ইয়র্কে প্রিয় শিল্পী জন লেননের খোঁজ পেয়ে সেখানে চলে যায় সে। হোটেল ভাড়া করে কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করে। লেননের গান ভালোবাসলেও তাঁর একটি সমালোচিত উক্তি খুব ভোগাতো এ যুবককে। “The Beatles are more famous than Jesus” – এ একটি বাক্যের কারণে লেনন কম আক্রোশের শিকার হননি। হঠাৎ করেই প্রিয় গায়কের প্রতি তীব্র ঘৃণা জন্ম নেয় চ্যাপম্যানের মনে।
১৯৮০ সালের সেই রাত
সেদিন ছিলো ৮ ডিসেম্বর। নিজের একক এ্যালবাম ‘Double Fantasy’-র প্রচারণায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন লেনন। স্ত্রী ইয়োকো ওনোর সাথে বাসা থেকে বেরিয়ে স্টুডিওতে যাচ্ছিলেন। যথারীতি এক দঙ্গল ভক্ত দৌড়ে আসে। লেননকে ঘিরে ধরে চারপাশ থেকে। সে ভিড় ঠেলে নিঃশব্দে এগিয়ে যায় চ্যাপম্যান। তার হাতে নতুন অ্যালবামের একটা কপি। বিনা বাক্যব্যয়ে সেটা লেননের দিকে এগিয়ে দেয় চ্যাপম্যান। মুচকি হেসে তাতে অটোগ্রাফ দেন লেনন। তারপর বলেন, “Is this all you want?” চ্যাপম্যান নিশ্চুপ। শুধু একবার মাথা নাড়ে।
গাড়িতে করে চলে যান লেনন। ঘণ্টাখানেক স্টুডিওতে গান রেকর্ড করে আবার ফিরে আসেন। তখন রাত প্রায় এগারোটা। ক্লান্ত লেনন-ওনো এগিয়ে যাচ্ছেন বাসার দিকে। রাস্তার এদিকটা কিছুটা নির্জন। অন্ধকার গলি থেকে বেরিয়ে আসলো চ্যাপম্যান। তাকে অতিক্রম করে যান লেনন-ওনো। ওভারকোটে লুকানো রিভলবার থেকে বের করে চ্যাপম্যান। পেছন থেকে লেননকে ৫ টি গুলি করে। একটি বুলেট লেননের মাথার পাশ কেটে চলে যায়, বাকি চারটা আঘাত করে তাঁর বুকে।
মুহূর্তেই লুটিয়ে পরেন লেনন। রক্তে ভেসে যায় তাঁর শার্ট, চশমার কাঁচেও রক্তের ছোপ। গুলির আওয়াজে আতংকিত মানুষ ছুটে আসে লেননের কাছে। তখনো তিনি জীবিত ছিলেন। মিনিটখানেকের মধ্যে পুলিশ আর অ্যাম্বুলেন্স আসে। নিকটস্থ রুজভেল্ট হসপিটালে নেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে মৃত ঘোষণা করা হয় সঙ্গীতের এ রাজপুত্রকে।
লেননকে খুন করে রাস্তার অপর পারে গিয়ে ভাবলেশহীন চ্যাপম্যান ফুটপাতে বসে বই পড়া শুরু করে। উপন্যাসের নাম “The Catcher in the Rye”। বইটা কোটের ভেতরে ছিলো। তার শান্ত অবয়ব দেখে মনেই হবেনা এইমাত্র সে একটা মানুষ খুন করেছে। এক পুলিশ অফিসার চ্যাপম্যানের উদ্দেশে চিৎকার করে বলেন, “Do you know what you have just done?”
“Yes, I just shot John Lennon,” মৃদুকন্ঠে চ্যাপম্যান উত্তর দেয়।
চ্যাপম্যানকে আটক করার সময় বইটিও উদ্ধার করা হয়। প্রথম পাতায় গোটা গোটা অক্ষরে “This is my statement” লেখা ছিলো তার প্রথম পাতায়। “I just sought a way to be someone I wasn’t. To be loved.” – লেননকে হত্যা করার কারণ হিসাবে চ্যাপম্যান বলেছিলেন এ কথা।
২৫ বছরের সেই মার্ক ডেভিড চ্যাপম্যান আজও বহাল তবিয়তে বেঁচে আছেন। কারাগারের বদ্ধ ঘরে।
মাত্র ৪০ বছরের জীবনে জন লেননের ক্যারিয়ার সত্যিই বিস্ময়কর। একজন বিকারগ্রস্ত মানুষ তাঁর হৃদস্পন্দন থামিয়ে দিয়েছে ঠিকই। কিন্তু কালজয়ী গানগুলো মানুষ ভালোবেসে যাবে চিরকাল।
চাইলে জন লেননের হত্যাকাণ্ড নিয়ে বানানো সিনেমা “Chapter 27” দেখতে পারেন। আততায়ী মার্ক ডেভিড চ্যাপম্যানের চরিত্রে অভিনয় করেছেন জেরেড লেটো।