বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যে কয়েকজন মানুষ তাঁদের সর্বশক্তি দিয়ে এ সংগ্রামের বিরোধিতা করে গেছেন, তাদের মধ্যে তৎকালীন নিক্সন প্রশাসনের পররাষ্ট্র মন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হবে। ঠাণ্ডা যুদ্ধের সে যুগে একদিকে চীনের সাথে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা আর অন্যদিকে সোভিয়েত বলয়ের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক মিত্র পাকিস্তানকে পাশে রাখার নীতিকে সামনে নিয়ে চলা কিসিঞ্জারের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ ছিলো গলার কাঁটা। তবে স্বাধীনতাবিরোধী অবস্থানের কারণে বাংলাদেশিদের কাছে কিসিঞ্জার যতটা নিন্দিত হয়েছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি নিন্দা জুটেছে তার তথাকথিত “বাংলাদেশ “তলাবিহীন ঝুড়ি” বক্তব্যের কারণে।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে বিষয়টিকে আপাতদৃষ্টিতে সত্য মনে হলেও, সত্য হচ্ছে হেনরি কিসিঞ্জার সম্ভবত এমন কিছুই বাংলাদেশের ব্যাপারে বলেননি!
হেনরি কিসিঞ্জার ও “তলাবিহীন ঝুড়ি”
হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে ঠিক কবে বটমলেস বাস্কেট বলেছিলেন, তার কোন সঠিক ধারণা পাওয়া যায় না। তবে কোন কোন লেখক-গবেষক ও সংবাদ মাধ্যমের দাবী তিনি ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সফরে এসে এই কথা বলেছিলেন।
১৯৭৪ সালের ৩০ অক্টোবর হেনরি কিসিঞ্জার একটি সরকারি সফরে বাংলাদেশে আসেন। স্বাধীন বাংলাদেশে এটাই ছিলো কোন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রথম সফর। হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশ সফরকালে দুইটি বৈঠক করেন – প্রথমটি পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. কামাল হোসেন (বাংলাদেশ সময় তিনটা থেকে পাঁচটা) এবং দ্বিতীয়টি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে।
এ সফর সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব ফখরুদ্দীন আহমদের বই ‘উত্তাল তরঙ্গের দিনগুলি’ থেকে। বইটির ১২৪ থেকে ১২৬ পৃষ্ঠায় হেনরি কিসিঞ্জারের বাংলাদেশ সফরের বিবরণ আছে। ফখরুদ্দীন আহমদ দুইটি বৈঠকেই উপস্থিত ছিলেন।
বইটি থেকে জানা যায়, হেনরি কিসিঞ্জার তার সফরে কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামে মার্কিন সমর্থিত সরকারের পক্ষে বাংলাদেশের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে কীভাবে সাহায্য করতে পারে তা জানতে চান কিসিঞ্জার। তিনি যে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ফোর্ডের আদেশে এসেছেন তা পরিষ্কার করেন এবং সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি হাফেজ আল আসাদের ব্যাপারে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন।
বইটির লেখক কিসিঞ্জারকে বিমানবন্দরে গ্রহণ করা থেকে শুরু করে তার সাথে সব বৈঠকেই উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয় তুলে ধরেছেন লেখায়। বৈঠকের কোন অংশে কিংবা বিমানবন্দরে বা অন্য কোন জায়গায় কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলেছেন এমন বর্ণনা বইটির কোথাও পাওয়া যায় না। এত বড় একটি বিষয় লেখক জেনে শুনে এড়িয়ে গেছেন, এমনটা বিশ্বাসযোগ্য না।
এ ব্যাপারে আরেকটি ভালো তথ্যসূত্র হচ্ছে মার্কিন দূতাবাসের গোপন নথি বা টেলিগ্রাম, যেগুলো প্রযুক্তির বদৌলতে এখন উইকিলিকসের মাধ্যমে সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। হেনরি কিসিঞ্জারের ঢাকা সফরের আগে-পরে অন্তত এক ডজন টেলিগ্রাম পাঠানো হয় ঢাকার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস থেকে। এর মধ্যে বৈঠকের অংশগ্রহণকারী থেকে শুরু করে আলোচ্য বিষয়ের বিবরণ পাওয়া যায়।
এমন একটি টেলিগ্রাম হচ্ছে ‘1974DACCA04967_b’। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে সেদিন ডিনারে কিসিঞ্জার যা বলেছিলেন, তাঁর পূর্ণ বিবরণ এতে পাওয়া যায়। বিবরণের কোথাও বাংলাদেশকে বটমলেস বাস্কেট বলা হয়নি।
EXCHANGE OF DINNER TOASTS B… by Centro Sinistra on Scribd
বাস্কেট তত্ত্বের নেপথ্যে
বাংলাদেশ বিষয়ে “তলাবিহীন ঝুড়ি” তত্ত্বটি তাহলে কীভাবে এল, এ প্রশ্নের গভীরে গেলে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি বৈঠকের কথা। বৈঠকটি ছিলো Washington Special Actions Group-এর সদস্যদের। এতে সভাপতিত্ব করেন হেনরি কিসিঞ্জার। সেখানে তিনি ছাড়াও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাইশজন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। এর মধ্যে ছিলেন ইউএসএইডের ডেপুটি অ্যাডমিনিস্ট্রেটর মরিস উইলিয়ামস এবং পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্সের আন্ডার-সেক্রেটারি উরাল অ্যালেক্সিস জনসন।
বৈঠকের এক পর্যায়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচনার সে অংশটি ছিলো অনেকটা এমন –
উইলিয়ামস: সেখানে কিছুদিনের মধ্যে ফসল সংগ্রহের মৌসুম শুরু হতে যাচ্ছে।
কিসিঞ্জার: আগামী বসন্তের পরে (দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা আছে)?
উইলিয়ামস: হ্যাঁ, যদি না তাঁরা মার্চের মধ্যে নিজেদের আগের অবস্থায় ফিরিয়ে না নিতে পারে।
কিসিঞ্জার: আমাদেরকে তখন খাদ্য সহায়তা পাঠাতে হতে পারে?
উইলিয়ামস: হ্যাঁ।
কিসিঞ্জার: তাহলে এ ব্যাপারে এখনই চিন্তা ভাবনা শুরু করা উচিত।
উইলিয়ামস: মার্চের মধ্যে বাংলাদেশের আরো অনেক ধরনের সহায়তা প্রয়োজন হতে পারে।
জনসন: সেটা হবে একটা ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেট কেস।
কিসিঞ্জার: হ্যাঁ, তবে শুধু আমাদের বাস্কেট কেস না।
পরবর্তীতে এ বৈঠকের কথোপকথন বাইরে চলে আসতে শুরু করে। ১৯৭২ সালের জানুয়ারির ৭ তারিখে নিউ ইয়র্ক টাইমসে ক্যাথরিন টেলৎশের একটি বিশেষ লেখা ছাপা হয় বাংলাদেশের স্বীকৃতির বিষয়ে, যার শিরোনাম ছিলো “Nations Cautious on Bangladesh”। সেখানে এ ঘটনার স্পষ্ট উল্লেখ আছে।
সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশকে ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেট কেস হেনরি কিসিঞ্জার নন, বরং তাঁর দপ্তরের কর্মকর্তা উরাল জনসন বলেছিলেন। তবে কিসিঞ্জার তাঁর সহকর্মীর বক্তব্যের সাথে একমত ছিলেন।
পরে বাংলাদেশ নিয়ে বিভিন্ন লেখায় নিউ ইয়র্ক টাইমস এ বাস্কেট কেসের বিষয়টি সামনে আনে। ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে বাংলাদেশকে নিয়ে প্রকাশিত একটি সম্পাদকীয়র শিরোনামই ছিলো “Basket Case”। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে বাকশাল ব্যবস্থা কায়েমের পর পত্রিকাটি বাংলাদেশ নিয়ে একটি লেখার শিরোনাম করে “One Man’s Basket Case”।
তবে বাংলাদেশকে নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমসের তলাবিহীন ঝুড়ি তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হতে থাকে সময়ের সাথে সাথে। ১৯৮১ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতিকে হত্যার পর পত্রিকাটি একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিলো “Don’t Write Off Bangladesh”। এর শেষ দুইটি বাক্য ছিলোঃ
বটমলেস বাস্কেট ও বাস্কেট কেসের প্রশ্ন
প্রথম প্রশ্নটা হচ্ছে বটমলেস বাস্কেট বা তলাবিহীন ঝুড়ি কী? কেন একটা দেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলা হয়? একটা দেশ কীভাবে তলাবিহীন ঝুড়ি হয়?
আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় তলাবিহীন ঝুড়ি হচ্ছে এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে যত সম্পদ বা সাহায্যই দেয়া হোক তা সেই রাষ্ট্রটি গিলে ফেলে এবং কোন কাজে লাগাতে পারে না। সমস্যা হচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিভাষায় তলাবিহীন ঝুড়ি শব্দযুগলের কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায় না, কিংবা শব্দটির ব্যবহার যদি থাকেও তা বহুল প্রচলিত নয়। তাই বাংলাদেশকে বটমলেস বাস্কেট বলার মাধ্যমে ঠিক কী বোঝানো হয়েছে তা জানাটাও একটু কঠিন বৈকি।
তবে এই ক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, বটমলেস বাস্কেটের ধারণার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ একটি শব্দযুগল আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক অনেক জার্নাল, পত্রিকার কলাম কিংবা লেখায় পাওয়া যায়, তা হলো- বাস্কেট কেস।
বাস্কেট কেস শব্দটির উৎপত্তি খুব সম্ভবত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। জানা যায়, যুদ্ধে যখন কোন সৈনিক তাঁর দুটো হাত-পা হারিয়ে এককভাবে চলাফেরায় অক্ষম হয়ে পড়তেন তখন তাঁকে বাস্কেট কেস বলা হতো। তেমনি যেসব রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্র কিংবা আন্তর্জাতিক সংস্থার সাহায্য-অনুদান ছাড়া রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় কার্যাদি সম্পন্ন করতে পারে না এমন রাষ্ট্রগুলোকে বাস্কেট কেস বলা হয়ে থাকে। বর্তমানে এমন বাস্কেট কেস রাষ্ট্রের কথা বললে সুদান কিংবা সোমালিয়ার কথা বলা যায়।
তথ্যসূত্র
- ফখরুদ্দীন আহমদ, ‘উত্তাল তরঙ্গের দিনগুলি’ (দিব্য প্রকাশ, ২০০১)
- Mohammad Rezaul Bari, “The Basket Case” (Forum, The Daily Star, Volume 3 Issue 3 | March 2008)