রূপকথা বলতে সাধারণত বিশেষ ধরনের ছোটগল্পকে বুঝানো হয়, যেগুলো দীর্ঘদিন একটি সংস্কৃতির লোকসাহিত্যে চর্চিত এবং লোকমুখে প্রচারিত। রূপকথার গল্পে অনেক কাল্পনিক চরিত্র, প্রানী-উদ্ভিদ, কল্পনার অনেক স্থানের বর্ণনা থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ গল্পের মাধ্যমে কোন একটা বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, ঈশপের গল্পের ক্ষেত্রে যেটা এসেছে এক লাইনের উপদেশ আকারে।
ঠাকুরমার ঝুলি
বাংলায় রূপকথার একেবারে আকরগ্রন্থ বলা যায় ঠাকুমার ঝুলিকে। দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদার দেশঘুরে গল্প সংগ্রহ করেছিলেন বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে। তার সম্পাদনায় এই গল্পগুলো সংকলিত হয় ১৯০৭ সালে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম সংস্করণের ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন। ঘুমন্তপুরী, ডালিমকুমার, লালকমল-নীলকমল কিংবা শেয়াল পন্ডিতের মতো সবসময়ের জনপ্রিয় আঠারোটি গল্পের সংকলন এই বইটি। ছোট পরিধির এই গল্পের শেষেও গুরুত্বপূর্ণ হলো একটি উপদেশ, যা এই ধরনের Fable ধারার গল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্যের একটি। দুই বাংলাতেই ঠাকুরমার ঝুলি বেশ জনপ্রিয় ছিলো, এখনো নাটক-সিনেমা- অ্যানিমেশানে নির্মাণ-পুননির্মাণ চলছে গল্পগুলোর।
রামায়ণ-মহাভারত
সর্বভারতীয় লেন্সে মাপলে রামায়ণ এবং মহাভারত লোককাহিনীর অজস্র উপাদানে ভর্তি। ভারতীয় রূপকথা নিয়ে প্রধান কাজ করেছেন অস্ট্রেলিয়ান গবেষক Joseph Jacobs, তাঁর বই Indian Folk Tales এ সংকলিত হয়েছে সারা ভারতেই বেশ জনপ্রিয় উনত্রিশটি গল্প। যথারীতি প্রতীকী চরিত্রের মাধ্যমে এক বা একাধিক বার্তা দেওয়া হয়েছে গল্পের শেষে।
নাসিরুদ্দিন-হাতেম তাই
পাকিস্তানের বেশিরভাগ লোককাহিনী ভারতেও প্রচলিত। দুটি চরিত্র খুব জনপ্রিয় দুই দেশেই। এরা হলো হাতেম তাই আর মোল্লা নাসিরুদ্দিন। হাতেম তাই সেই কিংবদন্তী,ধর্মপ্রাণ, দয়াশীল মানুষ, যিনি নিজের হত্যাকারীকেও ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। তার দানশীলতা, মাহাত্ম্য নিয়ে প্রচলিত অনেক গল্পের সংকলন ‘দাস্তান-ই-হাতেম-তাই’। মোল্লা নাসিরুদ্দিন বা নাসিরুদ্দিন হোজ্জা মধ্যযুগে,সেলজুক আমলে তুরস্কের সুফি ঘরানার সাধক ছিলেন। তার জীবনের বিভিন্ন রসাত্মক ছোটগল্প ( Anecdotes ) পরে প্রচার পেয়েছে লোকমুখে ও বিভিন্ন ভাষায় লিপিবদ্ধ হয়েছে। সত্যজিৎ রায়-ও মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্পগুলোর একটি সংকলন করেছিলেন। পাকিস্তানি রূপকথা-তে ইসলামি ও পারস্য সংস্কৃতির প্রভাব-ও বেশ স্পষ্ট।
চীন-ভারতের মিশেল
সংস্কৃতির বৈচিত্র্য কিংবা সীমানা সবদিক থেকেই চীন বিশাল। তাওইজম, বুদ্ধিজম আর কনফুসিয়াসের প্রভাব রয়েছে এদেশের লোককাহিনীতে। আরো আছে জেনগুরুদের গল্প, বুদ্ধের বাণীর প্রয়োগ সংক্রান্ত এই গল্পগুলো চলে আসছে হাজার বছর ধরে। বিভিন্ন জীবজন্তুর প্রতীকী ব্যবহার চৈনিক রূপকথার প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রসঙ্গক্রমে আসে ড্রাগন, পাহাড়ি ঘোড়া কিংবা ব্যাঙ। চীনের লোকসাহিত্যে ব্যাঙ সম্পদশীলতা আর দীর্ঘজীবনের প্রতীক। তাওবাদী আর কনফুসিয়াসপন্থীদের তর্ক প্রায়শই চৈনিক রূপকথাগুলোর অনুষঙ্গ আকারে এসেছে। তিব্বতের ভিক্ষুগুরুদের মধ্যে প্রচলিত আছে হাজারবছরের পুরনো অনেক জ্ঞানের কাহিনী। নেপাল এবং ভুটানের রূপকথা এইধরনের গল্প দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। চীন ও ভারতের লোক-কাহিনীর অনেক অপভ্রংশ এই দুইদেশে প্রচলিত।
শ্রীলঙ্কান রূপকথা
ভারত সাগরে উপমহাদেশের দক্ষিণসীমায় অবস্থিত দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কার লোককাহিনীতে রামায়ণের উপাদান প্রচুর। রাবণের কথিত বাসস্থান ছিল শ্রীলঙ্কায়। রাম-সীতার জীবনকাহিনী নিয়ে ছোট ছোট গল্প এসেছে সেসব রূপকথায়। ব্যাঙ রাজপুত্রের গল্প বিশ্বজোড়া রূপকথায় পরিচিত একটি কাহিনী। শ্রীলঙ্কার লোককাহিনীতেও ব্যাঙ রাজপুত্রের গল্প পাওয়া যায়। অবশ্য লোককাহিনীর ক্ষেত্রে এটি বেশ স্বাভাবিক ঘটনা। বিভিন্ন সংস্কৃতির রূপকথার অনুষঙ্গ কিংবা চরিত্র পরিবর্তিত হলেও গল্পের বিন্যাস আর বার্তায় আশ্চর্যজনক মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
রূপকথা বা লোককাহিনীকে বলা হয় “Timeless Tales”; এই গল্পগুলোর কোন দেশ-কাল হয় না, সবসময়ের, সব দেশের এই গল্পগুলো। তারপরও একই আঞ্চলিক সংস্কৃতিতে রূপকথায় অনেক সামঞ্জস্যের দেখা মেলে। এই উপমহাদেশের রূপকথায় যেমন ব্রাহ্মণ, দৈত্য, রাজা-উজির, ঘুমন্তপুরীর বর্ণনা এসেছে, তেমনি বীরবল-আকবরের অনেক গল্প এখন লোককাহিনীর উপাদান হয়ে গেছে। রামায়ণ আর মহাভারত শক্ত প্রেক্ষাপট দিয়েছে কয়েক হাজার বছর ধরে, এসব নিয়েই আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের রূপকথা।
This article is made possible by the support of the American People through the United States Agency for International Development (USAID.) The contents of this article are the sole responsibility of the Quizards project and do not necessarily reflect the views of USAID or the United States Government.