রূপকথা শুনতে কার না ভালো লাগে! রাতের বেলা ঘুমোবার আগে মায়ের মুখে রূপকথার গল্প শোনা কিংবা স্কুলের পড়া বাদ দিয়ে নানান ছবিতে ভরা রূপকথার গল্পের বইয়ে ডুবে থাকা – এমন অভিজ্ঞতা আমাদের প্রায় সকলেরই রয়েছে। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি জাতির নিজস্ব রূপকথা রয়েছে, যেগুলো আবহমান কাল ধরে প্রচলিত রয়েছে। তবে সাহিত্যের এই বিশেষ অংশ প্রথম আনুষ্ঠানিক রূপ পেয়েছিল ইউরোপীয় সাহিত্যিকদের হাত ধরে। যুগের পর যুগ অগণিত সাহিত্যিক রূপকথা লিখে বা সংকলন করে গিয়েছেন। আমরা আজকে ইউরোপীয় রূপকথার মহারথী চার্লস পেরো, হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসেন এবং গ্রিম ভাই-দেরকে নিয়ে জানার চেষ্টা করবো।
চার্লস পেরো
ইউরোপীয় সাহিত্যিকদের মাঝে যারা প্রথম গতানুগতিক সাহিত্যের পাশাপাশি লোকসাহিত্য এবং রূপকথার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছিলেন, চার্লস পেরো তাঁদের মাঝে অন্যতম। তিনি ১৭শ শতাব্দীর শেষার্ধের অন্যতম একজন সাহিত্যিক ছিলেন। ফ্রেঞ্চ এই গল্পকারের রূপকথাগুলো ইউরোপের বাইরেও সমানভাবে বিখ্যাত।
১৭শ শতাব্দীর শেষার্ধে ইউরোপের সাহিত্যিকদের মাঝে প্রথাগত সাহিত্য এবং লোক সাহিত্যের গুরুত্ব নিয়ে বিরোধের সৃষ্টি হয়। বেশিরভাগ সাহিত্যিক প্রথাগত নিয়মে সাহিত্যচর্চায় আগ্রহী ছিলেন এবং তারা লোকসাহিত্যকে নিম্নমানের সাহিত্য বলে গণ্য করতেন। চার্লস পেরো তৎকালীন একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক হয়েও রূপকথা এবং অন্যান্য লোকসাহিত্যের প্রতি সমান গুরুত্ব প্রদানে সোচ্চার ছিলেন। নিজে রূপকথা লেখার পাশাপাশি তিনি ফ্রান্স এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে প্রচলিত লোককথা ও রূপকথা সংকলনে উদ্যোগী হন।
১৬৯৭ সালে “টেল্স অব মাদার গুজ” নামক তাঁর একটি রূপকথার সংকলন প্রকাশিত হয়, যেটি ছিল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত প্রথম রূপকথার সংকলন। এই সংকলনে তাঁর স্বরচিত আটটি রূপকথার গল্প ছিল, যাদের মাঝে অন্যতম “সিন্ডারেলা”, “দ্য স্লিপিং বিউটি”, “লিটল রেড রাইডিং-হুড”, “দ্য মাস্টার ক্যাট (যার আরেকটি নাম পুস ইন বুটস), “ব্লু বিয়ার্ড” প্রভৃতি। এছাড়া পরবর্তীকালে তাঁর আরো কিছু রূপকথার গল্প ও সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল।
আজকের সাহিত্যে রূপকথার যে সৌন্দর্যময় বিচরণ আমাদের মুগ্ধ করে, তার পেছনে চার্লস পেরোর অবদান অপরিসীম। রূপকথাকে সাহিত্যের অন্যতম এবং সমৃদ্ধ একটি অংশ হিসেবে গড়ে তোলার পথে তিনি ছিলেন একজন পথিকৃৎ।
হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসেন
রূপকথা সাহিত্যের সবচেয়ে বিখ্যাত লেখক হিসেবে গণ্য করা হয় হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসেনকে। তার জন্মভূমি ডেনমার্ক। তিনি চার্লস ডিকেন্সের সমসাময়িক এবং তাঁর একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন; যদিও সে বন্ধুত্ব স্থায়ীত্ব লাভ করেনি। পেশাজীবনের প্রথমদিকে অপেরা গায়ক হিসেবে কাজ করলেও পরবর্তীতে তিনি কবি ও লেখকের জীবন বেছে নেন।
পিতার মৃত্যু ও মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের কারণে অ্যান্ডারসেনের শিক্ষাজীবন কেটেছে আবাসিক বিদ্যালয়ে। শারীরিক নিগ্রহের শিকার হওয়ায় তাঁর শৈশব ও কৈশোর বিষণ্ণতায় কেটেছে। বাবার কারণে প্রথাগত সাহিত্যের চেয়ে রূপকথার প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল। “এ জার্নি অন ফুট ফ্রম হোমেন’স ক্যান্যাল টু দ্য ইস্ট পয়েন্ট অব অ্যামেজার” নামক বইয়ের মাধ্যমে তিনি আলোচনায় আসেন। তাঁর অন্যান্য সাহিত্যকর্মের চেয়ে রূপকথাধর্মী ছোটগল্পগুলোই অধিক বিখ্যাত হয়েছে। অ্যান্ডারসেনের অন্যতম রূপকথাগুলো হলো “দ্য আগলি ডাকলিং”, “দ্য লিটল মারমেইড”, “দ্য এমপেরর’স নিউ ক্লোদ’স”, “দ্য প্রিন্সেস অ্যান্ড দ্য পি” প্রভৃতি।
অ্যান্ডারসেনের অধিকাংশ রূপকথার পেছনে তাঁর নিজের জীবন অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল বলে মনে করা হয়। অনেক সাহিত্যবোদ্ধা মনে করেন, নিজেকে তুলনামূলক কম সুদর্শন মনে করতেন তিনি, আর এই ধারণা থেকে হয়তো “দ্য আগলি ডাকলিং” গল্পটি রচনা করেছিলেন। তাঁর অধিকাংশ গল্পের মাঝে নানা ব্যক্তিগত আক্ষেপ ও হতাশা যেমন খুঁজে পাওয়া যায়, তেমনি অনুভব করা যায় অনুপ্রেরণার ছোঁয়া।
গ্রিম ভাইয়েরা (জ্যাকব ও উইল্হেম গ্রিম)
জ্যাকব গ্রিম ও উইল্হেম গ্রিম অর্থাৎ গ্রিম ভাইয়েরা রূপকথা সাহিত্যের অন্যতম বিখ্যাত কুশীলব। ১৮শ শতকের শেষদিকে জার্মানিতে তাঁদের জন্ম হয় এক বছরের ব্যবধানে। তাঁরা দুজনে পেশাগত জীবনে যথাক্রমে অধ্যাপক এবং লেখক ছিলেন। চার্লস পেরো ও হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসেন রূপকথা সাহিত্যে গ্রিম ভাইদের অগ্রজ হলেও গ্রিম ভাইদের সৃষ্ট সাহিত্যকর্মের সংখ্যা ও খ্যাতি তাঁদের দুজনকেই ছাপিয়ে যায়।
গ্রিম ভাইদের সাহিত্যকর্মগুলো শিশু-কিশোরদেরকে সহজেই আকৃষ্ট করে ফেলে। নিজেদের স্বতন্ত্র রূপকথা লেখার পাশাপাশি জার্মানির লোকসাহিত্যের পৃষ্ঠপোষণা এবং পূর্বের সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্ম সংকলন ও অনুবাদেও তাঁদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। অধ্যাপনা ও সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি গ্রিম ভাইরা তৎকালীন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের নানা কার্যকলাপেও অংশগ্রহণ করতেন। এমনকি একারণে তাঁদেরকে তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের রোষের মুখেও পড়তে হয়েছিল। গ্রিম ভাইয়েরা তাঁদের সাহিত্যচর্চার একটা বড় সময় কাটান প্রুশিয়াতে, হয়ত সে কারনেই তাঁদের গল্পগুলোতে রয়েছে বৈচিত্র্যের ছোঁয়া।
গ্রিম ভাইদের বিখ্যাত গল্পগুলো হলো “দ্য ফ্রগ প্রিন্স”, “দ্য গোল্ডেন গুজ”, “স্নো হোয়াইট”, “হ্যানসেল অ্যান্ড গ্রেটেল”, “র্যাপানজেল”, “রাম্পেলস্টিল্টস্কিন” প্রভৃতি। এসকল গল্প অসংখ্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে , অগণিত শিশু-কিশোর এসকল গল্পে মাতোয়ারা হয়েছে এবং হচ্ছে।
রূপকথার রাজ্যে পথপ্রদর্শক হিসেবে যাঁদের গণ্য করা হয়, পেরো, অ্যান্ডারসেন ও গ্রিম ভাইদের নাম তাঁদের মাঝে আসবেই। তাঁদের রূপকথাগুলো আজও শিশু-কিশোরদের কাছে তুমুলভাবে জনপ্রিয়। শুধু তাই নয়, তাঁদের কারণে লোককথা ও রূপকথাও পেয়েছে সাহিত্যের মর্যাদা, লোকসাহিত্যের সংকলন পেয়েছে নতুন মাত্রা। তাই যতদিন সাহিত্যের সাম্রাজ্যে রূপকথা আপন মহিমায় বিদ্যমান থাকবে, ততদিন পর্যন্ত এই মহারথীদের নামও অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
This article is made possible by the support of the American People through the United States Agency for International Development (USAID.) The contents of this article are the sole responsibility of the Quizards project and do not necessarily reflect the views of USAID or the United States Government.