আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ক্যালেন্ডার এতটাই স্বাভাবিক ব্যাপার যে এর উৎপত্তি নিয়ে আমরা খুব একটা মাথা ঘামাই না। এক বছরে ৩৬৫ দিন, প্রতি চার বছরে ফেব্রুয়ারি মাস ২৮ দিনের পরিবর্তে ২৯ দিনের হয় – সহজ হিসাব! আসলেই কি তাই?
বর্তমানে আন্তর্জাতিকভাবে যে ক্যালেন্ডারটি অনুসরণ করা হয়, সেটি গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। অথচ ৫০০ বছর আগেও এর ব্যবহার ছিলো না। দিনের হিসাব রাখার ব্যবস্থা কীভাবে বিবর্তিত হয়ে আজকের অবস্থায় এসেছে, সে ব্যাপারে টুকটাক জানা যাক।
রোম থেকে শুরু
প্রথম রোমান রাজা রোমিউলাসের শাসনামলে রোমান ক্যালেন্ডারের প্রচলন ঘটে বলে ধারণা করা হয়। মার্চ থেকে বছর শুরু হওয়া এ ক্যালেন্ডারে ছিলো ১০ মাস (৩০৪ দিন)। বাদ পড়ে গিয়েছিলো শীতকাল। পরবর্তীতে খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ সালে রাজা নুমা পম্পিলিয়াস জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাস যোগ করে ৩৫৪-৩৫৫ দিনে নিয়ে যান রোমান ক্যালেন্ডারকে। তবে চাঁদের গতিবিধির উপর নির্ভরশীল এ ক্যালেন্ডার ঋতুর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিলো না। রাষ্ট্রীয় শাসনে থাকা কিছু প্রভাবশালী মানুষ নিজেদের সুবিধামতো দিন-মাস যোগ করতেন। অবশেষে রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটান।
এলাম, দেখলাম, ক্যালেন্ডার বানালাম
ভালো মানের একটি ক্যালেন্ডার তৈরির জন্য সসিজেনিস নামের আলেক্সান্ড্রিয়ার একজন জ্যোতির্বিদের পরামর্শ গ্রহণ করেন রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার। এ জ্যোতিবির্দ প্রাচীন মিশরীয়দের হিসাব ব্যবহার করেছিলেন। ফলে নতুন ক্যালেন্ডারে সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর আবর্তনকাল ৩৬৫ দিন ৬ ঘণ্টা নির্ধারণ করেন তিনি। সৌর বছরের সাথে হিসাব মেলানোর জন্য প্রতি চার বছরে ফেব্রুয়ারির সাথে অতিরিক্ত একটা দিন যোগ করা হয়।
সসিজেনিসের সমাধান সহজ হলেও সঠিক ছিলো না। কারণটা পরিষ্কার। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে একবার ঘুরে আসতে গড়ে ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড সময় নেয়। মূল সৌর বছরের সাথে জুলিয়ান বছরের পার্থক্য তাই প্রায় ১১ মিনিট ১৫ সেকেন্ডের!
পৃথিবীর আবর্তনের উপর ভিত্তি করে ২০-২২ জুনের মধ্যে কোন একটা তারিখ উত্তর গোলার্ধে সবচেয়ে লম্বা দিন (দক্ষিণ গোলার্ধের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ছোট) ও ২১-২৩ ডিসেম্বরের মধ্যে কোন একটা তারিখ সবচেয়ে ছোট দিন (দক্ষিণ গোলার্ধের ক্ষেত্রে সবচেয়ে লম্বা)। এ সৌর ঘটনাগুলো সুনির্দিষ্ট। জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে লিপ ইয়ার থাকা সত্ত্বেও দিনের হিসাব এলোমেলো হয় এ ধরনের নির্দিষ্ট সৌর ঘটনার কারণে। অবশ্য এমন ভুল জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের প্রসারে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি। বছর গণনার মানসম্মত ব্যবস্থা হিসাবে পরিচিতি পেয়ে যায় এটি।
বর্তমান ক্যালেন্ডার
ষোড়শ শতাব্দীতে পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরির উদ্যোগে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অচল হয়ে পড়ে। তবে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের ভুল সংশোধনের জন্য তিনি এ কাজ করেন নি। কারণটা ধর্মীয়!
আগের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ইস্টার ঠিক সময়ে পালন করা সম্ভব হচ্ছিলো না। ব্যাপারটা তৎকালীন ক্যাথলিক চার্চকে ভাবিয়ে তোলে। তাই ক্রিস্টোফার ক্ল্যাভিয়াস নামের এক জ্যোতির্বিদকে সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব দেন পোপ গ্রেগরি।
ক্ল্যাভিয়াসের প্রস্তাবনা অনুযায়ী লিপ ইয়ারের জন্য তিনটি শর্ত যোগ করা হয়ঃ
– বছরটিকে ৪ দিয়ে ভাগ করা যাবে।
– শতাব্দীর (যেমনঃ ২০০০, ১৯০০) বেলায় বছরটিকে ১০০ দিয়ে ভাগ করা গেলেই হবে না (জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে যেটি স্বাভাবিক ছিলো), একে ৪০০ দিয়েও ভাগ করা সম্ভব হবে।
১৫৮২ সালে পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরির নির্দেশনা অনুযায়ী নতুন ক্যালেন্ডার কার্যকরী হয়। ধীরে ধীরে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এ ব্যবস্থা। বিংশ শতাব্দীতে সারা বিশ্বে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের ব্যবহার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
বোনাস তথ্যঃ
– ক্রিস্টোফার ক্ল্যাভিয়াসের আগে অ্যালয়সিউস লিলিউস নামে আরেকজন ইতালিয়ান জ্যোতির্বিদ নতুন ক্যালেন্ডারের উপর কাজ করেন।
– বহু প্রোটেস্ট্যান্ট নতুন ক্যালেন্ডারকে ক্যাথলিক ষড়যন্ত্র হিসাবে নিয়েছিলেন।
– ১৭৫২ সালে যখন ব্রিটেনে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার চালু হয়, তখন জনসাধারণ প্রতিবাদে নেমেছিলো ১১ দিন হারানোর কারণে!
– ১৯১৭ সালে রাশিয়ান বিপ্লবের আগ পর্যন্ত সেখানে নতুন ক্যালেন্ডার গ্রহণযোগ্য ছিলো না। মজার ব্যাপার হলো, এ কারণে ১৯০৮ সালের লন্ডন অলিম্পিকে রাশিয়ান দল ১২ দিন দেরিতে এসে পৌঁছায়!
নির্ভুল বলে কিছু নেই
যদিও গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার নিয়ে আমাদের কোন সমস্যা হয় না, একটা ব্যাপার খেয়াল রাখা দরকার। এ ব্যবস্থাতেও ছোট একটা সমস্যা থেকে গেছে। গ্রেগরিয়ান বছর মূল সৌর বছরের চেয়ে প্রায় ২৬-২৭ সেকেন্ড লম্বা। অর্থাৎ প্রতি ৩২৩৬ বছরে প্রায় ১ দিনের হিসাব ওলটপালট হবে এ ক্যালেন্ডারে। ৪৯০৯ সালের আগে আমরা অবশ্য নিশ্চিন্ত থাকতে পারি!
বোনাস তথ্যঃ
সংশোধিত জুলিয়ান ক্যালেন্ডার গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের চেয়েও নির্ভুল হিসাব দিতে পারে। সৌর বছরের সাথে এর পার্থক্য আনুমানিক মাত্র ২ সেকেন্ডের। তবে লিপ ইয়ার গণনার ক্ষেত্রে জটিল শর্ত ব্যবহার করা হয় এতে।